Advertisement
০২ মে ২০২৪
International Tiger Day

বাঘ দিবসে স্মৃতি হাতড়ায় সুন্দরবন

প্রায় বাইশ বছর আগে, সেই ‘দক্ষিণ রায়’ দাঁতের আগায় ঝুলিয়ে সন্তোষ মণ্ডলকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাদাবনে। তাঁর জনা পাঁচেক সঙ্গী জেলে নৌকা ভরে কাঁকড়া, নোনা চিংড়ি নিয়ে ফিরেছিলেন গ্রামে।

Royal Bengal Tiger

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ ০৮:০৫
Share: Save:

উঠোনে জলচৌকেতে বসে দ্রৌপদী বলছিলেন, ‘‘এমনই এক দুপুরে হেঁতাল বন থেকে তিনি ধেয়ে আসবেন তা কে জানত!’’

প্রায় বাইশ বছর আগে, সেই ‘দক্ষিণ রায়’ দাঁতের আগায় ঝুলিয়ে সন্তোষ মণ্ডলকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাদাবনে। তাঁর জনা পাঁচেক সঙ্গী জেলে নৌকা ভরে কাঁকড়া, নোনা চিংড়ি নিয়ে ফিরেছিলেন গ্রামে। সন্তোষের কোনও ছবি নেই ঝড়খালির বাড়িতে। এক ছেলে, দুই মেয়ে আর দ্রৌপদীর কাছে সন্তোষ রয়ে গিয়েছেন তাঁর পারিবারিক মনখারাপের ফ্রেমে।

দ্রৌপদী বলছিলেন, ‘‘গেঁওখালির বনে ওঁর বাঘে ছেঁড়া দেহটার খোঁজে যেতে চেয়েছিল সঙ্গী-সাথীরা। আমিই মানা করি। দক্ষিণ রায় যাঁরে নিয়ে গিয়েছে সে বাদাবনেই শান্তিতে ঘুমোক!’’ বন দফতরের খাতায় চিরতরেই ‘মিসিং’ হয়ে গিয়েছেন সন্তোষ।

সুন্দরবনে, বাঘের পড়শি হিসেবেই যাঁদের আজন্ম দিনযাপন, আর্ন্তজাতিক বাঘ দিবসে তাঁদের কথাই বলছিলেন বন বিভাগের উপদেষ্টা, বাঘ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী— ‘‘অন্নসংস্থানের টানে সুন্দরবনের জল-জঙ্গলে হাতের মুঠোয় প্রাণটুকু নিয়ে ওঁরা বেরিয়ে পড়েন। ঘরে ফেরা হবে কিনা জানেন না।’’ সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের এক কর্তা বলছেন, ‘‘সুন্দরবনের নদী-নালায় কিংবা বনের গভীরে মাছ আর মধুর খোঁজে নিত্য পাড়ি দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বন দফতরের বৈধপারমিট মেলে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে। সিংহভাগেরই পারমিট থাকে না। ফলে বাঘ বা কুমিরে টেনে নিয়ে গেলে পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণও জোটে না।’’

ঝড়খালি, মায়াদ্বীপ, লাহিড়িপুর— সুন্দরবনে ছড়িয়ে থাকা জনবসতের স্মৃতিতে এমন অজস্র সন্তোষ রয়ে গিয়েছেন নিশ্চুপে। ঝড়খালির নেতাজিপল্লির মালতী মণ্ডল তুলে আনেন সাতাশ বছর আগের কথা। বলেন, ‘‘ছোট মেয়েটা তখন হাঁটতে শিখেছে। মানুষটা যাওয়ার আগে, ওকে আদর করে বলে গেল, এসে ভাত খাবে। ফিরল ওর লাশ!’’ চামটার জঙ্গলে জাল বোঝাই মাছ ধরে নৌকায় ওঠার মুখেই স্মরদীপ মণ্ডলকে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ‘দক্ষিণ রায়।’ মালতী বলেন, ‘‘এখন ঝড়খালির স্কুলে মিডডে মিল-এর রান্না করি।’’

দু’একটি আশ্চর্য ফিরে আসার কাহিনিও জ্বলজ্বল করছে। ঝড়খালি ২ নম্বরের বাসিন্দা অনাথ মণ্ডল তাঁর বাম চোয়াল আর কানে গভীর ক্ষত নিয়ে বলছেন, ‘‘বাঁচব ভাবিনি। কিন্তু কাকাকে বাঘে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেখে মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম। হাতের বৈঠা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম খাঁড়িতে। তেনার (বাঘ) পিঠে সর্বশক্তি দিয়েদু’ঘা বসাতেই কাকাকে মাটিতে ফেলে বাঘ এ বার আমার উপরে ঝাঁপাল।’’ তাঁর মুখ আর পাঁজর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে বুঝেও তখনও হাল ছাড়েননি অনাথ। শেষতক বনে ফিরে গিয়েছিলেন দক্ষিণ রায়। কাকা-ভাইপোকে কোনও রকমে নৌকায় তুলে পাড়ি দিয়েছিলেন সঙ্গীরা। কিন্তু নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছনোর আগেই মারা গিয়েছিলেন কাকা প্রবীর মণ্ডল। প্রায় আড়াই মাস ক্যানিং হাসপাতালে চিকিৎসার পরে ঘরে ফিরলেও বাঁ কান আর চোখে, শ্রবণ আর দৃষ্টিশক্তি ফিকে হয়ে গিয়েছে তাঁর। কমে গিয়েছে বাঁ পায়ের জোর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Royal Bengal Tiger Sundarbans
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE