Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পাঁচ হাসপাতালে ঠোক্কর

সেরিব্রালের রোগিণীকেও ফেরাল পিজি

শেষ পর্যন্ত নীলরতন সরকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ছাত্রীকে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেখানে নিউরোলজি বিভাগের মেঝেতে শোয়ানো অজ্ঞান সঞ্চিতার পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন তাঁর কাকা তরুণ সরখেল।

এনআরএস হাসপাতালের মেঝেয় সঞ্চিতা সরখেল। ছবি: সুমন বল্লভ।

এনআরএস হাসপাতালের মেঝেয় সঞ্চিতা সরখেল। ছবি: সুমন বল্লভ।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৭ ১২:৩০
Share: Save:

দ্রুত শুশ্রূষা নয়। বরং সঙ্কটজনক রোগীকেও কী ভাবে পত্রপাঠ দরজা দেখিয়ে দেওয়া যায়, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মধ্যে লাগাতার সেই প্রতিযোগিতা দেখছেন ভুক্তভোগীরা!

চোখে পেরেক বিঁধে যাওয়া বালক করিম মোল্লার পরে পাঁচ-পাঁচটি হাসপাতালে ঠোক্কর খেতে হলো সেরিব্রাল অ্যাটাকে হতচেতন কলেজছাত্রী সঞ্চিতা সরখেলকে। পাঁচ হাসপাতালের মধ্যে সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএমের ঘটনা ভয়াবহ। ওই ছাত্রীকে ভর্তি না-নিয়ে সেখানকার কিছু ডাক্তার রীতিমতো মারধরের হুমকি দিয়ে তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছেন বলে রোগিণীর আত্মীয়দের অভিযোগ। পিজি-র সুপার মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্য ভবন থেকে সব জেনেছি। গোটা বিষয়টিই খতিয়ে দেখছি। দোষ প্রমাণিত হলে দোষীরা শান্তি পাবেন।’’

শেষ পর্যন্ত নীলরতন সরকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ছাত্রীকে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেখানে নিউরোলজি বিভাগের মেঝেতে শোয়ানো অজ্ঞান সঞ্চিতার পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন তাঁর কাকা তরুণ সরখেল। অসহায়তা আর উদ্বেগে তাঁর মুখ সাদা। প্রলাপের সুরে বলছিলেন, ‘‘মরে যাবে মেয়েটা। আর বোধ হয় ওকে বাঁচাতে পারলাম না। চিকিৎসাটুকুও করাতে পারলাম না। কী অপদার্থ আমি!’’

দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সঞ্চিতা গত শনিবার বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের রামানন্দ কলেজে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিষ্ণুপুর সদর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা জানায়, সেরিব্রাল অ্যাটাক। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অবস্থা গুরুতর। তৎক্ষণাৎ যাঁর অস্ত্রোপচার দরকার ছিল, সেই মেয়েকে নিয়ে শনি থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত এক সরকারি হাসপাতাল থেকে অন্য সরকারি হাসপাতালে পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন তাঁর বাড়ির লোকেরা। কিন্তু অস্ত্রোপচার দূরের কথা, চিকিৎসাটুকুও পাননি ওই ছাত্রী!

শেষ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের তরফে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। তাঁর নির্দেশে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ এনআরএসে ভর্তি করানো হয় ওই তরুণীকে। স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ মানছেন, বাঁকুড়ায় মস্তিষ্কে জরুরি অস্ত্রোপচারের সরকারি পরিকাঠামো নেই। কারণ, নিউরোসার্জারি বিভাগটাই নেই বাঁকুড়া মেডিক্যালে। কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ প্রকল্পে সেখানে একটি সুপার স্পেশ্যালিটি ব্লক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই ব্লকে কাজ শুরু হতে এখনও অনেক দেরি।

সঞ্চিতার সঙ্গীদের অভিযোগ, ‘‘মঙ্গলবার সকালে এসএসকেএমে পৌঁছনোর পরে ইমার্জেন্সি থেকে আমাদের বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিতে এমআরআই করতে পাঠানো হয়। পিপিপি মডেলের পরীক্ষা কেন্দ্রে সাত হাজার টাকা দিয়ে এমআরআই করাই। ওরা বাঁকুড়ায় করানো স্ক্যান রিপোর্টও জমা নেয়। বলে, রিপোর্ট মিলবে কাল। তত ক্ষণ রোগীকে ভর্তি করা যাবে না!’’

বাড়ির লোকেরা জানান, এর পরে তাঁরা সঞ্চিতাকে ভর্তি করার জন্য এসএসকেএমের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের হাতে-পায়ে ধরেন। তরুণবাবুর কথায়, ‘‘ইমার্জেন্সির ডাক্তারবাবুদের পায়ে ধরলে ওঁদের এক জন বলেন, ‘একদম নাটক করবেন না। মেরে তাড়িয়ে দেবো। বেরিয়ে যান।’ অগত্যা সঞ্চিতাকে ট্যাক্সিতে তুলে নীলরতনে আসি।’’

এনআরএসের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবুরা স্ক্যান আর এমআরআই রিপোর্ট দেখতে চান। তরুণবাবুরা জানান, রিপোর্ট বাঙুরে জমা রয়েছে। সেই কেন্দ্র তত ক্ষণে বন্ধ। কিন্তু অভিযোগ, রিপোর্ট নেই শুনে সেখানকার চিকিৎসকেরা রোগিণীকে ছুঁয়ে দেখতেই অস্বীকার করেন। নীলরতন-কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন, ঘটনাটি সত্যি। তাঁরা দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন।

‘‘স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা। গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখনও অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছে। আমাদের সব গুছিয়ে আনতে হবে। চেষ্টা চলছে,’’ বলেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিসবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE