বাড়ির দেওয়ালে চকচকে পোস্টারে জ্বলজ্বল করছে থানার আইসি, স্থানীয় এসডিপিও, পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর। রাস্তা থেকে বাড়ির দিকে শ্যেনদৃষ্টি রাখছে নতুন সিসি ক্যামেরা। দাওয়ায় এবং ভিতরের দালানে সিভিক ভলান্টিয়ার, রাস্তায় ঘনঘন আনাগোনা পুলিশের গাড়ির।
এ সবের দিকে যেন বিদ্রুপের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভাঙা দরজাটা! একটু দূরে টাঙ্গির কোপে দো’ফলা হয়ে যাওয়া সজনে গাছটাও। যার তলায় পড়ে ছিল প্রৌঢ়ের নিথর দেহ। কয়েক হাতের মধ্যে ছেলের।
শমসেরগঞ্জের জাফরাবাদে আক্রোশের চিহ্ন বয়ে পড়ে থাকা পাড়া এখন এমনই বৈপরীত্যের সমাহার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসতে পারেন কোথাও ফাঁক রাখছে না পুলিশ। যা দেখিয়ে নিহত প্রৌঢ়ের ছোট ছেলে রবিবার বিকালে বলছিলেন, ‘‘এখন পোস্টার লাগিয়ে পুলিশের ফোন নম্বর দিয়েছে।চারপাশে এত পুলিশ। সে দিন চার ঘণ্টা হামলা চলার সময়ে পাড়ার লোকের এত ডাকাডাকি শুনে পুলিশ এলে বাবা আর দাদাকে এ ভাবে হারাতে হত না!’’ দুয়ারে মুখ্যমন্ত্রী এলে বলতে পারবেন এ কথা? তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তূরে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করা যুবকের উত্তর, ‘‘চেষ্টা করব। জানাতে হবে তো কী হয়েছে আমাদের সঙ্গে। এই ক্ষতির কি পূরণ হয়!’’
নিহত বাবা-ছেলের পরিবারকে নিয়ে টানাটানি অবশ্য নাটকীয় মোড় নিয়েছে। পুলিশ যখন নজরদারিতে ব্যস্ত, তারই মধ্যে স্বামীহারা দুই মহিলা চলে গিয়েছেন কলকাতায়। কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত চেয়ে তাঁদের দিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন করানোর তোড়জোড় করছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিধাননগরের যে বাড়িতে দুই মহিলাকে রাখা হয়েছে, খবর পেয়ে এ দিন সেখানে ‘অপহরণের অভিযোগ’ নিয়ে হানা দিয়েছিল পুলিশ। বিজেপি নেতা কৌস্তভ বাগচী, সজল ঘোষ, তরুণজ্যোতি তিওয়ারিদের বাধায় তাঁদের অবশ্য পুলিশ ওখান থেকে বার করতে পারেনি। মহিলারাও জানান, তাঁরা স্বেচ্ছায় এসেছেন। পরে পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল আচরণের অভিযোগ করে শুভেন্দু দাবি করেছেন, ‘‘ওই পরিবার কলকাতায় গিয়েছে, হাই কোর্টে মামলা করবে। পুলিশের তদন্তে আস্থা নেই। সিবিআই তদন্ত চাইবে হাই কোর্টে। পুলিশের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছে! কাল রাত থেকে ওই পরিবারের উপরে খুব অত্যাচার হয়েছে।’’ রাজ্যের মন্ত্রী আখরুজ্জামান অবশ্য বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সোমবার মুর্শিদাবাদে আসছেন। তিনিই যা বলার, বলবেন।’’
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার জবাবে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তরফে এক্স হ্যান্ডলে লেখা হয়েছে, ‘কোনও কোনও মহল থেকে’ পুলিশের বিরুদ্ধে ওই পরিবারকে হুমকি দেওয়ার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা ‘সর্বৈব মিথ্যা’। যদিও একটি সূত্রের দাবি, ওই পরিবারের তরফে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের কাছে চিঠি লিখে নিরাপত্তার আর্জি জানিয়ে বলা হয়েছে, তাঁদের যেন কলকাতা হাই কোর্টে নিরুপদ্রবে মামলা করতে যেতে দেওয়া হয়। তদন্ত প্রসঙ্গে এক পুলিশ-কর্তার বক্তব্য, ‘‘বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গড়ে তদন্ত হচ্ছে, অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়েছে। দু’জন পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। আর এলাকায় পুলিশ-প্রশাসনের তরফ থেকে যা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সবই মানুষের আস্থা বাড়ানোর জন্য।’’
কিন্তু আস্থা বেড়েছে কি? তিনপাকুড়িয়া পঞ্চায়েতে দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা, ৭২ বছরের দীনবন্ধু প্রামাণিকের গলায় এখনও আতঙ্ক— ‘‘আমরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় দেখেছি। ও’পার থেকে লোক চলে এসেছে। এই অশান্তি হয়নি। মুর্শিদাবাদে রাজনৈতিক গোলমাল হয় কিন্তু এই তাণ্ডব! সে দিন সকাল থেকে কোথায় ছিল পুলিশ, কোথায় ছিল বিধায়ক-সাংসদ?’’
‘মৃতদেহে আতর ছড়িয়ে’ কী লাভ প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী কটাক্ষ করছেন, ‘‘পুলিশ ময়দানে নেমে পড়েছে নিহতদের পরিবারের লোকজনকে মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে ওঠাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলবেন, আমি আছি, কোনও চিন্তা নেই! গুলিবিদ্ধ ১৭ জন। তাঁদের কাছে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী?’’
মুখ্যমন্ত্রীর সফরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে প্রশাসন, শাসক দল। সেই সঙ্গেই থেকে যাচ্ছে দীনবন্ধুদের উত্তর সন্ধান— এ কোন মুর্শিদাবাদ? এ কেমন হিংসা?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)