Advertisement
E-Paper

‘ছোয়াধরা’ গুজব ঘিরে রাজনীতির চাপানউতোর

ছেলেধরা গুজব রটিয়ে গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটছে এ রাজ্যেও। হয়েছে মৃত্যুও। কারা রটাচ্ছে এই গুজব? কেন?  আনন্দবাজারের প্রতিবেদন।রাজবংশী ভাষায় ছোয়া মানে ছেলে। পূর্ব মেদিনীপুর, মালদহ ঘুরে ‘ছেলেধরা’ হাওয়া ঢুকেছে জলপাইগুড়িতেও। জঙ্গল লাগোয়া ক্রান্তিতে কিছুদিন আগেই ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে সনাতন বিশ্বাসকে।

ছেলেধরা গুজব রটিয়ে গণধোলাইয়ের ঘটনা হয়েছে মৃত্যুও। প্রতীকী ছবি।

ছেলেধরা গুজব রটিয়ে গণধোলাইয়ের ঘটনা হয়েছে মৃত্যুও। প্রতীকী ছবি।

স্যমন্তক ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮ ০৫:০১
Share
Save

ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি। লাটাগুড়ি রেঞ্জের টহলদারি গাড়ি ঢুকছে কলাখাওয়া নজর-মিনারে। ডান হাতে গরুমারা। গুয়া-পান মুখে স্থানীয় ড্রাইভার গল্প জুড়েছেন— গ্রামে ঢুকে বাঘ গরু মেরে যেত, তাই ‘গরুমারা’। রসিকতা করে প্রশ্ন করা গেল, এখন কি তবে এলাকার নাম হবে ‘ছোয়াধরা’?

রাজবংশী ভাষায় ছোয়া মানে ছেলে। পূর্ব মেদিনীপুর, মালদহ ঘুরে ‘ছেলেধরা’ হাওয়া ঢুকেছে জলপাইগুড়িতেও। জঙ্গল লাগোয়া ক্রান্তিতে কিছুদিন আগেই ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে সনাতন বিশ্বাসকে। আপাতত তিনি পুলিশ হেফাজতে। সনাতনকে উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্রান্তি ফাঁড়ির পুলিশকর্মীরাও। যার জেরে ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। হবিবপুরের মতো এখানেও গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য। মাছি তাড়াচ্ছে ক্রান্তি বাজার।

ঘটনাচক্রে, মালদহের মতো এখানেও ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়েছে মূলত বিজেপি-প্রভাবিত অঞ্চলে। বার্তা ঘুরছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে। পূর্ব মেদিনীপুর এবং মালদহের মতো জলপাইগুড়িতেও এলাকাবাসীদের একাংশ বলছেন, চায়ের দোকানে এসে ছেলেধরা, মেয়ে পাচার, কিডনিচক্রের গুজব ছড়িয়ে চলে যাচ্ছেন ভিন রাজ্যের লোক।

ক্রান্তি ব্লক তৃণমূল সভাপতি শ্যামল বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘‘ছেলেধরা আসলে বিজেপির চক্রান্ত। লোকসভা ভোট পর্যন্ত এলাকায় অশান্তি জিইয়ে রাখার চেষ্টা।’’ বিজেপির মণ্ডল সভাপতি কমলেন্দু দেবশর্মার পাল্টা, ‘‘এটা তৃণমূলের চক্রান্ত। পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেখানে বিজেপি ভাল ফল করেছে, সেখানেই অশান্তি তৈরি করে কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’’ ক্রান্তির ঘটনায় পুলিশ যাদের
গ্রেফতার করেছে, তারা এলাকায় বিজেপি কর্মী-সমর্থক বলেই পরিচিত। ঘটনাচক্রে, ওই এলাকায় গত পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি’র ভোটও বেড়েছে ১০-১৫ শতাংশ।

সাম্প্রতিক গণধোলাইয়ের ঘটনার সূত্রপাত ক্রান্তি বাজার মোড়ের লটারি দোকানের সামনে। স্থানীয়েরা জানান, পাশের গ্রামের যুবক দিলীপ রায় লটারিওয়ালা জয়ন্ত বণিকের কাছে এসে সনাতনের মোবাইল এবং একটি বডি স্প্রে ‘জিম্মি’ রাখতে বলেন। এ-ও দাবি করেন, সনাতন ও তাঁর এক সঙ্গী সুপুরি কিনতে এসে রাস্তা চিনিয়ে দিতে বলেছিলেন। পুলিশের কাছে দিলীপের অভিযোগ, এরপর তাঁরা গাড়ি করে খানিক দূর যান। সেখানে তিনজন মদ্যপান করেন। তখনই নাকি সনাতন দিলীপের মুখে কিছু স্প্রে করে দেন। দিলীপ অসুস্থ বোধ করলে সনাতন তাঁকে নিয়ে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। খবর, এরপরই দিলীপ ফোন করে এলাকায় ‘ছেলেধরা’র খবর ছড়িয়ে দেন। শুরু হয় গণধোলাই।

ঘটনার এক সপ্তাহ পরে দোকানদারদের একাংশের আক্ষেপ, সনাতন যদি ‘ছেলেধরা’ই হবেন, তাহলে ‘অপহরণে’র পর তিনি গজলডোবা বা ওদলাবাড়ির রাস্তা না ধরে ক্রান্তি বাজার আসবেন কেন? লটারিওয়ালার সংযোজন, ‘‘সনাতনের পকেট থেকে টাকা তুলে নিয়েছিল দিলীপ।’’ যদিও দিলীপের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। তাঁর ফোন টানা বন্ধ।

ছেলেধরা-আতঙ্ক অবশ্য শুধু ক্রান্তিতেই আটকে নেই, পৌঁছেছে ময়নাগুড়িতেও। জনরোষের হাত থেকে বাঁচাতে ভিন রাজ্যের জনাকুড়ি ফেরিওয়ালাকে সম্প্রতি আটকও করেছিল পুলিশ। মধ্য এবং উত্তর ভারত থেকে আসা ওই গামলা বিক্রেতাদের সঙ্গে ছিল ‘মডিফায়েড’ মোটরবাইক এবং পিক আপ ভ্যান। যদিও কারা ছড়াচ্ছে গুজব বা কারা সেই গুজব ব্যক্তিগত বা সংগঠনগত স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছে— সে প্রশ্নে পুলিশ আপাতত নীরব।

১৯৯৭-২০০০ সাল পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গে গণপিটুনি নিয়ে সমীক্ষা করেছিলেন সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সমিত কর। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘তখন দু’টি বিষয় মনে হয়েছিল। এক, শিক্ষার অভাব। আমাদের ঐতিহ্যই হল ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’। খুব সহজেই মুখের কথা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যায় এবং ছড়িয়ে পড়ে। দুই, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। পঞ্চায়েত স্তরে মানুষ ধরে নিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বও নিজেদের হাতে। ফলে যে কোনও রটনায় গণধোলাই স্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক উস্কানি থাকলে এ ধরনের ঘটনা তো আরও বাড়বেই।’’

Lynching Child Lifter Death

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}