Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Poverty

গ্রামে ঠাকুর দেখে মেয়ের ফিরতে সন্ধ্যা হলেই মা অস্থির হন এখন

কাঁচা ঘরে উঠে দাঁড়ালেই ঘুরন্ত ফ্যানখানা মাথায় ঠেকে প্রায়। হাওয়ার ছিটে আসে কৃপণের মতো। তবু পাখাটা ঘুরছে, তা-ই ভরসা! 

মেয়ে ও মা: সোনালি ও পাতামণি হেমব্রম। —নিজস্ব চিত্র।

মেয়ে ও মা: সোনালি ও পাতামণি হেমব্রম। —নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:৫৩
Share: Save:

কাঁচা ঘরে উঠে দাঁড়ালেই ঘুরন্ত ফ্যানখানা মাথায় ঠেকে প্রায়। হাওয়ার ছিটে আসে কৃপণের মতো। তবু পাখাটা ঘুরছে, তা-ই ভরসা!

নইলে এ পুজোয় রামপুরহাট বা বোলপুরে যাওয়া মাথায় উঠত তার। কলকাতাও যাওয়ার কথা ছিল বটে। প্যান্ডেলে আদিবাসী নাচের ব্যবস্থা থাকলে ইদানীং মান বাড়ে পুজোর। কিন্তু কলকাতার বাবুরা সঙ্গে বাউলও চাইছিল। গাঁয়ের এনজিও-র মাথা, আজহারদা তাই পিছু হটল। কোথাও যাওয়া হোক না হোক, হুকিংয়ের তারে ফ্যানটুকু ঘুরছে, এ বড় ভরসা। সবেধন নীলমণি জামাটা শুকোনো নিয়ে অন্তত ভাবতে হবে না।

সোনালি ভেবেছিল, পুজোর আগে আর একখানা জামা ঠিক কিনে ফেলা যাবে। টাইফয়েডে ভুগে গত মাসেই টানা এক হপ্তা ব্লক সদরের হাসপাতালে থাকতে হল। ওষুধ-ইঞ্জেকশনের খরচে হাতছাড়া হাজার দেড়েক। অগত্যা সরস্বতী পুজোয় মায়ের দেওয়া লাল জামাটাই ভরসা। ধান কাটার মজুরিতে ৭০০ টাকায় গাঁয়ের কালুয়া শেখের দোকান থেকে কিনেছিল মা। ওটাই পুজোর জামা! বিকেলে পুরানগ্রামে পুজো দেখে এসে, সকালে তেঁতুলবেড়িয়ায় সুশীল পাল, মিহির বাগদিদের ঘরে মুড়ি-নাড়ু কোঁচড়ে ভরে আনবে সোনালি। তার আগে রাতে কাচা জামা, ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া!

সাঁইথিয়ার কাছে মহম্মদ বাজারের রানিপুর গ্রামে দিন আনি-দিন খাই ঘরের পুজো। গাঁয়ের এক কোণে সব থেকে নিচুতলার পুজোও। একলা-মা পাতামণি হেমব্রমের মেয়ে সোনালিকে অবশ্য একডাকে চেনে গোটা গ্রাম। মোড়লপাড়ার মুজিবর শেখ, সওয়াল শেখ থেকে প্যাটেলনগরের ক্রাশার মালিক কমল খান, কিংবা পুরানগ্রামের ডিজে বক্স কারবারি অলক চৌধুরী থেকে মৌলবীসাহেব মুমতাজউদ্দিন, সবাই শুনেছেন তার কাণ্ড! গিরিপুর পুরানগ্রাম বৈকুণ্ঠনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের হেডস্যার রবিউল হক মোল্লা একটু বেশিই ভালবাসেন মেয়েটাকে। মায়ের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে মুম্বই গিয়ে বছর নষ্ট হয়েছিল সোনালির। আবার ফিরে ক্লাস নাইনে ভর্তির পরে ফর্মটা হাতে স্যর দেখেন, ধর্মের জায়গাটা মেয়ে ফাঁকা রেখেছে! গাঁয়ের আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের ‘হিন্দু’ লেখাই দস্তুর স্কুলে। অনেকে অবশ্য খ্রিস্টানও হচ্ছে ইদানীং। ওটা ভুল করে বাদ গিয়েছে ভেবে ডাকতেই মেয়ে বলে, ‘না স্যর! ছোট থেকেই দেখছি, শুনছি, ধর্ম মানেই খুনাখুনি! হিন্দু, মুসলিম কেউ কাউকে দেখতে পারে না!’ শুনে বাক্যিহারা রবিউল মাস্টার। মেয়েটার দু’চোখ তত ক্ষণে জলে উপচে পড়ছে।
১৫ বছরের ছোট্ট জীবনে দাগ কেটে গিয়েছিল দু’টো ঘটনা! বাবা জয়ধন হেমব্রমের টিবি সারাতে পটেলনগরে মন্দিরে পাগলের মতো মাথা খুঁড়ছিল মা! পুরোহিতরা টাকা নিল শুষে-নিংড়ে, তার পরে বলল, যাওয়ার টাইম হয়েছে, আর কী-ই বা করার! আর একটা ঘটনা টাটকা। মুম্বইয়ে, মীরা রোডে। রাজমিস্ত্রির কাজে গাঁয়ের এক দল মুসলিমের সঙ্গেই গিয়েছিল সাঁওতাল ঘরের মা-মেয়ে! হঠাৎ কোন ঝামেলায় রাস্তায় মারপিট, চেঁচামেচি!
ঘরেও দরজায় লাথি, জানে মারার হুমকি। মাকে জড়িয়ে সিঁটিয়ে ছিল মেয়ে। মজুরির অর্ধেকের বেশি টাকা ফেলে তড়িঘড়ি গ্রামে ফেরে মা-মেয়ে। হেডস্যরের সামনে সে-দিনটা ভেবেই কাঁদছিল সোনালি। রবিউল সাহেব শেষতক মেনে নেন, অনড় কিশোরীর দাবি।
জেদের এই গল্পই ঘুরপাক খায় পাড়াগেঁয়ে বাতাসে। গোটা গ্রাম হাঁ করে তাকায়, রোগা মেয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে বলছে, মানত-কবচ-ভূত-ডাইন কিছুই মানি না। স্কুল পাশ করে নার্স হব একদিন। এই জেদের খেয়ালেই পুজোর ছুটির পালে এখন মুক্তির বাতাস। সোনালির মামা তাম্বা হেমব্রম, মঙ্গল হেমব্রমেরা সদ্য খ্রিস্টান হয়েছেন। ইদানীং পুজো দেখার নামে পিছপা। সোনালির কাছে বড়দিন, পুজো— সবই সমান! গির্জার গান শোনে আবার পুরানগ্রামে দুপুররোদে ঠাকুর গড়া দেখে। পড়শি-বাড়ির ইদের মাংস, পুজোর খিচুড়ি— কিছুই ফেলবার নয়!
স্বামীহারা পাতামণির কাছেও ধর্মের বিলাসিতা ঘুচে গিয়েছে। মেয়ের ইচ্ছেয় বাধা দেয় না মা। পুজোর অনুষ্ঠান সামনে! পটেলনগরে এনজিও-র স্কুলে আদিবাসীদের সোহরাই, বাহা নাচ শিখতে যায় মেয়ে। মা ভাবেন গ্রামের মিঠুন শেখের কাছে মুনিষ খাটার ৫০০ টাকা আগাম পেলে গুগলি-কাঁকুড়ির বদলে মেয়েকে পুজোয় একদিন মাংস রেঁধে দেবেন।
কষ্টের বারোমাস্যায় অবশ্য বদল নেই। গ্রামে ঠাকুর দেখে মেয়ের ফিরতে সন্ধ্যা হলেই মা অস্থির হন এখন। কয়েক মাস আগেই বিয়ের সন্ধ্যায় গ্রামে একটা মেয়ের সঙ্গে কারা খারাপ কাজ করেছে। সোনালির থেকে কয়েক বছরের বড় হবে মেয়েটা। সমবয়সিরা পুজোর জামা গোনে, মেলায় খরচ করে। সোনালি বলে, মনখারাপ হলে ঘরে মাকে জড়িয়েই শুয়ে থাকি আমি!
কাঁচা ঘরে জাপ্টে শুয়ে মা-মেয়ে। টিমটিমে হলদেটে আলোয় ছায়াময় অভাব ও ভয়ের অসুর! নামমাত্র হাওয়ার ছিটেয় পাখাটা ঘুরতে থাকে! পুজোর জামাটা ঠিক শুকোবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poverty New Garments Secularism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE