বেচাকেনা। মঙ্গলবার দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেটে।—নিজস্ব চিত্র।
আলুর ট্রাক আটক করার প্রতিবাদে সোমবার হিমঘর থেকে আলু তোলা বন্ধ রেখেছিলেন তাঁরা। মঙ্গলবার সেই আন্দোলন উঠে গেলেও আলু ব্যবসায়ীরা জানিয়ে দিলেন, বহু আলু ট্রাকেই নষ্ট হয়েছে। তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিক সরকার। না হলে ফের আন্দোলনের পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ফলে রাজ্যে আলুর সঙ্কট তীব্রতর হলেও রাজ্য সরকারের ওপরে চাপটা রেখেই দিলেন ব্যবসায়ীরা। গত দু’দিনে এক বারের জন্যও বৈঠকে বসেনি সরকারের টাস্ক ফোর্স। কৃষি বিপণন দফতরের অফিসারদেরও দেখা যায়নি বাজারে। অথচ মঙ্গলবার বিভিন্ন বাজার থেকে ২২ টাকা কেজি দরের জ্যোতি আলুও উধাও হয়ে যায়। কোথাও আবার চন্দ্রমুখী আলুর দর ওঠে ৩০ টাকা কেজি।
রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ের আশ্বাস, সরকার পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের কি কোনও রাস্তাই নেই? অরূপবাবুর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী নীতি তৈরি করবেন।” সেই আলু-নীতি কী হবে, তার কার্যকারিতা কতটা, সে সব কিছুই জানেন না কৃষি বিপণন মন্ত্রী। যদিও ঘটনা হল, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকার যা ব্যবস্থা নিয়েছে তা-ই এখন ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। আটক আলুর ট্রাক থেকে বস্তা নামিয়ে বোঝাই করা হচ্ছিল মিলনমেলার হ্যাঙারে। উপযুক্ত বাতানুকূল ব্যবস্থা না থাকায় সেই আলুতে পচন ধরতে শুরু করেছে। দূষিত হয়ে উঠছে মিলনমেলার পরিবেশ। আবার ট্রাকেও পচেছে বহু আলু। মিলনমেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা বহু আলু পিষে গিয়েছে ট্রাকের চাকাতেও।
ফলে আলু নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এ দিন গড়বেতায় থানা ও বিডিও অফিসের সামনে পচা আলু ভর্তি ট্রাক নিয়ে বিক্ষোভ দেখান প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যেরা। সাধারণ সম্পাদক বরেন মণ্ডল বলেন, “ইতিমধ্যে ৬০-৭০ লরি আলু নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পচে যাওয়া আলু এখন কলকাতা থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এগুলো নিয়ে আমরা কী করব?” আজ, বুধবার বর্ধমানে সংগঠনের কোর কমিটির বৈঠকে তাঁরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন বলে বরেনবাবু জানান।
কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু এ দিন নবান্নে জানান, গত শনিবার থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত ২৫২টি ট্রাক ভর্তি আলু আটক করা হয়েছে। আটক হওয়া আলুর পরিমাণ ৪ হাজার ১১৭ টন। মিলনমেলায় ডাঁই হওয়া ওই আলু থেকে ভাল আলু বাছাই করতে পুরসভার সাহায্য চেয়েছে কৃষি বিপণন দফতর। মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ জানান, আলু বাছাইয়ের জন্য জনা ৫০ লোক পাঠানো হচ্ছে। রাত থেকেই তাঁরা বাছাইয়ের কাজ শুরু করবেন। বাছাই করা ওই আলু বাজারে ১৪ টাকায় বিক্রি করা হবে বলে কৃষি বিপণন দফতর সূত্রের খবর।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলে আসছেন, শুধু রাস্তা থেকে আলুর ট্রাক আটক করে বাজারে পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। হিমঘরে মজুত হওয়ার সময় থেকেই আলুর দামের দিকে নজর দিতে হবে। তা তো হয়ইনি, উপরন্তু এ বার বিষয়টি ক্রমশ আলু ব্যবসায়ীদের দাবিদাওয়ার দিকে ঘুরে যাচ্ছে। ফলে মূল সমস্যাটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বলে অনেকের আশঙ্কা।
টানা প্রায় তিন দিন হিমঘর থেকে আলু না আসায় এ দিন বাজারের পরিস্থিতি ছিল আরও খারাপ। ব্যবসায়ীদের একাংশের আশঙ্কা, আলুর দাম আরও বাড়তে চলেছে। যদিও সরকার জানাচ্ছে, মঙ্গলবারও বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে গিয়েছে আলুর ট্রাক। কিন্তু তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা যেমন বিশেষ আগ্রহী নন, তেমন বহু ক্রেতা গোড়া থেকেই সরকারি আলুর মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার কোলে মার্কেটে দেখা গেল, সরকারি আলুর ট্রাক এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাজারের প্রধান প্রবেশপথের সামনে। কিন্তু সেই আলু ট্রাক থেকে নামানোর কোনও ব্যস্ততা নেই। এক আলু ব্যবসায়ী জানালেন, “সরকারি আলুর বস্তা আমাদের কিনতে হচ্ছে ৬০০ টাকায়। এক বস্তায় ৫০ কেজি আলু থাকে। মুটে খরচ ২০ টাকা। সব মিলিয়ে বস্তা পিছু ৬২০ টাকা খরচ হচ্ছে। সরকার আমাদের এই আলুর বস্তা ৬২০ টাকাতেই বিক্রি করতে বলছে। তার মধ্যে আবার বেশ কিছু আলু নষ্ট থাকায় তা ওজনে বাদ যাচ্ছে। তা হলে লাভ থাকছে কোথায়?” মঙ্গলবার এখানকার বেশ কিছু আলু ব্যবসায়ীর দোকান ছিল বন্ধ। অনেকে আবার দু-এক বস্তা আলু নিয়ে বসে ছিলেন।
আলুর আর এক পাইকারি বাজার পোস্তাতেও এ দিন কোনও আলুর গাড়ি ঢোকেনি। ওই বাজারের ব্যবসায়ী বরুণ মুখোপাধ্যায় বলেন, “হিমঘরের কোনও আলু আমাদের বাজারে আসেনি। এই নিয়ে তিন দিন হয়ে গেল, কোনও আলুর ট্রাক ঢোকেনি আমাদের বাজারে। এ রকম চলতে থাকলে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে আমাদের বাজারে আলুই থাকবে না।”
প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য কমিটির সদস্য সাগর সরকার বলেন, “সোমবার আমরা এক দিনের প্রতীকী ধর্মঘট ডেকেছিলাম। কেউ হিমঘর থেকে আলু তুলিনি। মঙ্গলবার থেকে আমরা আলু তুলতে শুরু করেছি। আশা করি বুধবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।” হুগলির আলু ব্যবসায়ী অনিল সামন্ত জানান, তাঁরা ছোট ছোট লরি করে আলু কলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে খোলা বাজারে আলু যে ২০-২২ টাকার কমে বেচা যাবে না, ব্যবসায়ীরা তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
এ দিন আলু নিয়ে রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে ঝাড়খণ্ডের বহরাগোড়ার জগন্নাথপুরে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় মানুষ। প্রায় সাত ঘণ্টা বন্ধ থাকে ওই রাস্তা। পোড়ানো হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুলও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy