নির্লিপ্ত প্রভাস। বারাসত কোর্টে সোমবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
বিকেল তখন তিনটে বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। পাঁচ মিনিট আগেই আদালত কক্ষে আসামিদের রাখার ঘেরাটোপে আনা হয়েছে দোষী সাব্যস্ত হওয়া তিন জনকে। বারাসত আদালতের সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দমনপ্রসাদ বিশ্বাস তাঁর আসনে বসার পর প্রভাস ঢালি, সমীর মণ্ডল ও সুজিত ঢালিকে ঘেরাটোপ থেকে বাইরে আনা হল।
প্রভাসকে উদ্দেশ করে বিচারক বললেন, ‘‘এই মামলায় আপনাকে সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।’’ তার পর বাকি দুই দোষীকে বিচারক বললেন, ‘‘আপনাদেরও এক শাস্তি।’’ সাজা শুনেও অবশ্য তাপউত্তাপ দেখা গেল না প্রভাসের মধ্যে। বরং আদালতে দাঁড়িয়েই তার সদর্প ঘোষণা, ‘‘আমার ৫৯ বছর বয়স, এই কোর্টের আন্ডারেই ২৫টা খুন আছে আমার!’’
মধ্যমগ্রাম এলাকার কেমিয়া খামারপাড়ায় বিনয় বিশ্বাসের পরিবারের তিন জনকে খুনের মামলায় এই তিন জনের ফাঁসির আদেশ হল। প্রভাস ছিল উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকার ত্রাস। এই মামলা ছাড়াও বহু খুন ও ধর্ষণের মামলায় তার নাম আছে। গত বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর প্রভাস-সহ তিন জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
জমির দালালি নিয়ে বিরোধের জেরে ২০১২-র ১০ এপ্রিল রাতে বোমা-গুলি ছুড়তে ছুড়তে বিনয় বিশ্বাসের বাড়িতে প্রভাস চড়াও হয়। প্রথমে বিনয়ের বৃদ্ধ বাবা-মাকে গুলি করে বিনয়কে খুঁজে বার করে প্রথমে গুলি করা হয় এবং তার পর চপার দিয়ে কেটে দেওয়া হয় গলার নলি। বিনয়ের স্ত্রী শিউলিও গুলিতে জখম হন। বিনয়ের বড় ছেলে, নাবালক বিশ্বজিৎকে লক্ষ করেও গুলি ছোড়া হয়। ছোট ছেলে অভিজিৎ সব কিছু চোখের সামনে দেখে জ্ঞান হারায়।
ওই ঘটনার মাত্র দু’মাস আগেই কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল প্রভাস। সাত বছর কারাবাসের পর বাইরে বেরিয়েছিল সে। ২০১২-র নভেম্বরে আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটা থেকে প্রভাসকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
এ দিন শাস্তি ঘোষণার সময়ে আদালত কক্ষেই ছিলেন নিহত বিনয় বিশ্বাসের স্ত্রী শিউলিদেবী। বিচারক যখন দোষীদের প্রাণদণ্ড ঘোষণা করছেন, তখন তাঁর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। পরে, আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে শিউলি বলেন, ‘‘বাবা, ঠাকুরদা, ঠাকুরমাকে একসঙ্গে অমন নৃশংস ভাবে খুন হতে দেখে আমার ছেলে দু’টো যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। পশুদেরও কিছুটা মমতা থাকে। ওই খুনিদের সেটাও ছিল না। আমরা ওদের ফাঁসিই দেখতে চেয়েছিলাম।’’
বিচারক যখন প্রভাসের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করছেন, তখন তার চোখেমুখে কিন্তু আতঙ্ক বা অনুতাপের লেশমাত্র নেই। বরং ধোপধুরস্ত পোশাকে সে চশমার মধ্যে দিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। পরে সে চিৎকার করে বলে, ‘‘এর উপরেও আদালত আছে।’’
এ দিন বারাসত আদালতে উপস্থিত উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রভাস ঢালির মতো দুর্ধর্ষ অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পুলিশ কঠিন পরিশ্রম করেছে। তদন্ত যে সঠিক ছিল, এই রায় তার প্রমাণ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy