কর্তৃকারকের নাম সোশ্যাল মিডিয়া।
সে-বার পুণেয় একটি বহুজাতিক ফাস্টফুড চেনের আউটলেট আঁচটা অনুভব করেছিল। এ বার কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁ।
ঘটনার সূত্রপাত দিন দুয়েক আগে, যখন নিজের ফেসবুক পোস্টে এক মহিলা অভিযোগ করেন, তাঁর ড্রাইভারের পোশাক তেমন পরিচ্ছন্ন নয় বলে তাঁদের টেবিল দেননি রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়। নেট দুনিয়ায় জোরদার চর্চা শুরু হয়ে যায়। সোমবার রাতে দেখা যায়, ফেসবুকের ট্রেন্ডিংয়ে এক নম্বরে রয়েছে রেস্তোরাঁর ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা। জনপ্রিয় ফুড-সাইটে রেস্তোরাঁর রেটিং-এ আচমকা পতন!
মঙ্গলবার দেখা গেল, শুধু ভার্চুয়াল দুনিয়া না। বাস্তবেও রেস্তোরাঁর ভিড়ে জোর প্রভাব পড়েছে। ইদের কলকাতায় অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রেস্তোরাঁর টেবিল। বৈষম্যের অভিযোগ তুলে কয়েকটি গণসংগঠনের তরফে বিক্ষোভও দেখানো হয়েছে ওই এলাকায়।
ঠিক বছর দেড়েক আগে পুণেতেও খানিকটা এমনই ঘটেছিল। সে-বার ফুটপাথবাসী এক শিশুকে নরম পানীয়ের ‘ফ্লোট’ কিনে দিতে ফাস্টফুড চেনের আউটলেটে ঢুকেছিলেন এক মহিলা। তাঁর অভিযোগ, মলিনবেশ শিশুটি ওই পরিবেশের উপযুক্ত নয় বলে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে ওই শিশুটির সঙ্গে রেস্তোরাঁর বাইরে নিজের ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন তিনি। সেই পোস্টও গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ ঘটনাটির তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁটি কী ভাবছে? এই মুহূর্তে টালিগঞ্জের নামী চিত্রপরিচালক থেকে দেশের প্রসিদ্ধ ফুড রাইটার অবধি তাঁদের সমালোচনায় মুখর। ওই ড্রাইভারকে রেস্তোরাঁয় সপরিবার ডেকে আপ্যায়নের দাবিও উঠছে। ‘মোক্যাম্বো’র কর্ণধার নীতিন কোঠারি নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘‘এখানে খেতে আসা অতিথিদের জাতি, ধর্ম, পেশা বিচার কখনও করা হয়নি। চালক, পরিচারক, বাচ্চাদের আয়ারা অনেক পরিবারের সঙ্গেই বসে খান। সব পোশাকের বৈচিত্র্যও এখানে স্বাগত। আমরা শুধু বলি, পোশাক পরিচ্ছন্ন হতে হবে।’’ তাঁর দাবি, জনৈক মহিলার সঙ্গী চালককে আটকানোর পিছনেও এই যুক্তিই দেওয়া হয়েছিল। যদিও ফেসবুকে মহিলা দাবি করেছেন, তাঁর সঙ্গী চালকের পোশাক মোটেও নোংরা ছিল না।
একদা টাক্সেডো বা বো-টাই না-থাকলে পার্ক স্ট্রিটে রেস্তোরাঁর ডান্সফ্লোরে যাওয়া যেত না! ‘ড্রেস কোড’ মানা হয়নি বলে অভিজাত ক্লাবে ঢুকতে বাধা পেয়েছেন নামী শিল্পী, এমন নজিরও আছে। সময় বদলের সঙ্গে ফিকে হয়ে এসেছে সে সব। নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন বলছেন, ‘‘আজ এক জন ড্রাইভারের হেনস্থা নিয়ে যে ভাবে এত মানুষ সরব হলেন, সেটা খুবই ইতিবাচক দিক।’’ সোশ্যাল মিডিয়ার জন্যই সম্ভব হল সেটা।
আবার উল্টো দিকে, সোশ্যাল মিডিয়ার এই হইচইয়ের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক প্রবণতাও কারও কারও চোখে পড়ছে, যার সবটা হয়তো সদর্থক নয়ও। যেমন মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের কথায়, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ার হইচইতে কখনও-সখনও বিশ্লেষণের ধৈর্যটা আমরা হারিয়ে ফেলি। ঝটপট ভাল-মন্দ বিচার করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। এটা কিন্তু ঠিক নয়।’’ মোক্যাম্বো-কাণ্ডে তেমন নজিরও আছে। সোমবার দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় মোক্যাম্বো নামধারী একটি পেজ থেকে কর্তৃপক্ষের নাম করে নানা আপত্তিকর কথা বলা হয়েছে। নেটিজেনরা অনেকে অতি সহজেই সেগুলো সত্যি বলে ধরেও নিয়েছেন। অথচ রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের দাবি, রেস্তোরাঁর নাম করে ভুয়ো ফেসবুক পেজ তৈরি করে অপপ্রচার চলছে। এর বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন ওঁরা। ইতিমধ্যে নিজেদের পেজ খুলে সেখানে যথাযথ তদন্তের আশ্বাসও দিয়েছেন।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া কী ভাবে মুড়ি-মিছরি মিশিয়ে দিতে পারে বা কোনও বিষয়কে অতিরিক্ত ফাঁপিয়ে তুলতে পারে, সেই বিপদের উঁকিটি অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না এতেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় অহরহ নানা মত ও হুজুগের ছড়াছড়িকে তাই নব্য ‘টেনি’-‘ঘনাদা’দের রমরমা হিসেবে দেখছেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক প্রশান্ত রায়। তাঁর মতে মুশকিলটা হল, ‘‘কলেজ ক্যান্টিন বা রকের আড্ডা কেউ রেকর্ড করত না! সোশ্যাল মিডিয়ায় সবই পোস্ট হয়ে খোদাই হয়ে থাকে। ফলে আলগা কথাও বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy