টিফিন খেয়েছে কি না কিংবা বাড়ি ফিরে হোমওয়ার্ক করেছে কি না, ফোন করে সেই খবর নেওয়ার জন্য বাবা-মায়েদের সময় আছে! কিন্তু তার ছোট-ছোট মন খারাপের খোঁজ নেওয়ার সময় নেই কারও। মন খারাপ জমতে জমতে অভিমান তৈরি হয়। অভিমান জমে তৈরি হয় নিজেকে চারপাশের মানুষদের থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। অবসাদ বাসা বাঁধে শিশুমনে।
আজ, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে শিশুদের এই অবসাদকেই বেশি গুরুত্ব দিতে চান মনোরোগ চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। তাঁদের মতে, যে একাকিত্বের বীজ পোঁতা হচ্ছে তা বহু ক্ষেত্রেই ভবিষ্যৎ জীবনের উপরে বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সময় থাকতে অভিভাবকদেরই সাবধান হওয়া জরুরি।
মনোরোগ চিকিৎসকেদের অনেকেই জানিয়েছেন, শিশুরোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তাঁদের চেম্বারে যে সব বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিয়ে আসেন, তাদের অনেকেই কথা বলা কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। কেন বন্ধ করেছে? দীর্ঘ কাউন্সেলিংয়ের পরে জানা গিয়েছে, তারা যখন কথা বলতে চেয়েছে, তখন বাবা-মা সেই কথা শোনার সময় দেননি। তারা টিফিন খেয়েছে কি না জানতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে খেলার সময় পাননি। এমন কী অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পরেও ব্যস্ত থেকেছেন তার খাওয়াদাওয়া এবং হোমওয়ার্ক নিয়েই। নিজের মনের ছোট ছোট ভাল লাগা-মন্দ লাগার কথা চেপে রাখতে রাখতে এক সময়ে তাই কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে তারা। পরিস্থিতি এমনই যে, বয়ঃসন্ধির একটি মেয়ে তার প্রথম বার পিরিয়ডের কথাও বাড়িতে গোপন করে গিয়েছে।
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ মনে করেন, ‘হেলিকপ্টার পেরেন্টিং’-ও শিশুদের মনে অবসাদ তৈরি করার একটা বড় কারণ। তাঁর ব্যাখ্যা, হেলিকপ্টার যেমন উপর থেকে সব কিছু দেখে, সে ভাবেই সন্তানের সব কিছুর উপরে বাবা-মায়ের নজরদারিকে বলে ‘হেলিকপ্টার পেরেন্টিং’। এতে শিশুর নিজের মতো করে বিকাশের কোনও অবকাশ থাকে না। সেই হতাশা ক্রমশ গ্রাস করে তাকে। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম দিকে ধরা পড়লে দ্রুত ঠিক করা যায়। কিন্তু মাসের পর মাস জমতে থাকলে সেটা অবসাদের চেহারা নেয়।’’ যাঁরা ছেলেমেয়েকে একা বড় করে তোলেন, সেই ‘সিঙ্গল পেরেন্ট’-দের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা বেশি হয় বলে নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন পায়েল।
গোটা পৃথিবী জুড়েই শিশুমনের এই চাপ এবং তার জেরে তৈরি হওয়া অবসাদ বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ ফেলছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। বেসরকারি একটি মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রের সভাপতি কমল পারেখ মনে করেন, এ ব্যাপারে অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেরই ভূমিকা রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘সকলেই যদি একটু সংবেদনশীল হন তা হলে শিশুদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা, বিভিন্ন ধরনের নেশার প্রতি আসক্তি কমানো সম্ভব।’’
মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদার মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাবা-মা দুজনেই পেশাগত জীবনে ব্যস্ত থাকলেও সন্তানের মনের হদিস রাখার জন্য কিছুটা সময় রাখতেই হবে। তিনি বলেন, ‘‘কতটা সময় দিচ্ছেন সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু সেই সময়টুকুতে সন্তান কতটা তার নিজের কথা বাবা-মাকে বলতে পারছে, সেটাই আসল। মন খুলে কথা বলতে পারে না বলেই অনেক সময়ে শিশুদের উপরে যৌন নিগ্রহের ঘটনাও চাপা পড়ে থাকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy