অসিত মাহাতো, ভাস্কর মাহাতো ও চন্দন নন্দী
শাসকদলের যুব সভাপতি সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে গিয়েছিলেন, দলের নেতা খুনে দোষীদের তিন দিনের মধ্যে ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কার্যক্ষেত্রে সেটাই হল।
বাঁকুড়ার রাইপুরে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি অনিল মাহাতোকে খুন করায় অভিযুক্ত সাতজনের মধ্যেই তিনজনকে সময়সীমার শেষদিনেই পুলিশ গ্রেফতার করল। ধৃতেরা হলেন তৃণমূলের শ্যামসুন্দরপুর অঞ্চল সভাপতি ভাস্করচন্দ্র মাহাতো, রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতির বনভূমি কর্মাধ্যক্ষ অসিতবরণ মাহাতো এবং মেলাড়ার তৃণমূল নেতা চন্দন নন্দী। তাঁরা নিহত নেতার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বলে পরিচিত। বুধবার রাতভর জেরার পরে গ্রেফতার করে অশান্তি এড়াতে তাঁদের হিড়বাঁধ থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার ধৃতদের খাতড়া আদালতে তোলা হলে বিচারক তিনজনকেই সাত দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন। জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, “তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই ওই তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’’
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাইপুরের মটগোদায় নিজের পার্টি অফিসের সামনে মোটরবাইকে চড়ে আসা তিন আততায়ীর গুলিতে নিহত হন অনিলবাবু। ঘটনার পরেই অনিলবাবুর অনুগামীদের অভিযোগ তির ওঠে তাঁর বিরোধী গোষ্ঠী তথা রাইপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি জগবন্ধু মাহাতোর গোষ্ঠীর লোকজনের বিরুদ্ধে। অনিলবাবুর স্ত্রী সুলেখা মাহাতোও যে সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন, তার মধ্যে ব্লক সভাপতির অনুগামী কয়েকজন রয়েছেন। রবিবার নিহত নেতার বাড়িতে সমবেদনা জানাতে আসা অভিষেকের কাছেও সুলেখা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই তাঁর স্বামী খুন হয়েছেন বলে ক্ষোভ উগরে দেন। সেখানেই যুব সভাপতি জানিয়েছিলেন, যারাই এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকুক, তারা যেই হোক— ছাড়া পাবে না। যেখানেই থাকুক পুলিশ তাদের গ্রেফতার করবেই। পুলিশকে তিনদিনের মধ্যে দোষীদের গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে।
পুলিশ আগেই খাতড়ার এসডিপিও-র নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তদল গঠন করেছিল। তবে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ওই ঘোষণায় গ্রেফতারির জন্য যে তদন্তকারীদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল তা জেলা পুলিশের একটি অংশ স্বীকার করেছেন।
পুলিশেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, অনিলবাবুর বিরোধী বলে পরিচিত রাইপুরের এক ঝাঁক তৃণমূল নেতা-কর্মী থেকে ঠিকাদার, সরকারি কর্মীদের পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই ক’দিনে তা আরও বেড়েছে। দু’দিন ধরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি শান্তিনাথ মণ্ডল (তিনিও খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত)। তাঁর দাবি, ‘‘স্রেফ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে মিথ্যা অভিযোগে হেনস্থার শিকার হচ্ছি আমরা।’’ তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্লক সভাপতিও অভিযোগ করেছেন, ‘‘অনিলের খুনিরা যে গোষ্ঠীরই লোক হোক, তাদের শাস্তি চাই। তবে তদন্ত যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়।”
যদিও পুলিশের দাবি, ধৃত তিনজনের বিরুদ্ধে খুনের সঙ্গে যোগ থাকার তথ্য উঠে এসেছে। শ্যামসুন্দরপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অনিলবাবুর গোষ্ঠীর লোকজনের হাতে রয়েছে। এর আগে ওই পঞ্চায়েতে বহুবার অনাস্থা আনতে চেয়েও অনিলবাবুর প্রভাবে ব্যর্থ হয়েছেন ধৃত ওই অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি ভাস্করবাবু। পঞ্চায়েত সমিতির ভোটে তৃণমূলের অফিসিয়াল প্রার্থী অনিলবাবুর বিরুদ্ধে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে মাত্র এক ভোটে জিতেছিলেন অসিতবরণবাবু। ওই ভোটের কাউন্টিং প্রক্রিয়া নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন অনিলবাবু। বিষয়টি বিচারাধীন।
শীঘ্রই শুনানি হওয়ার কথাও ছিল বলে জানাচ্ছেন অনিলবাবুর অনুগামীরা। তাঁদের দাবি, পদ হারানোর ভয় কাজ করছিল অসিতবরণবাবুর মধ্যে। আর এক ধৃত চন্দনবাবুও অনিলবাবুর ঘোর বিরোধী ছিলেন। এক তদন্তকারীর কথায়, “ধৃতেরা অনিলবাবুকে খুন করার ব্যাপারে চক্রান্ত করেছিল। এ নিয়ে তারা একাধিক বৈঠক করেছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি।”
রাইপুর ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি অনিলবাবুর ঘনিষ্ঠ রাজকুমার সিংহ দাবি করেছেন, এই খুনের পিছনে আরও যাঁরা জড়িত, তারাও দ্রুত ধরা পড়ুক। অনিলবাবুর স্ত্রীর কথায়, “এই খুনের পিছনে আরও অনেক মাথাই থাকতে পারে। পুলিশ আসল ষড়যন্ত্রকারীকে ধরুক।”
বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী ঘটনার পরেই সন্দেহ করেছিলেন, মাওবাদীদের কাজ হতে পারে। এ দিন তিনি বলছেন, “পুলিশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে। আমরা চাই আরও গভীর তদন্ত হোক।”
—নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy