E-Paper

স্কুলের টানে হুইল চেয়ারেই পড়ান ‘বড়দি’

১৯৯২ সালের ৪ জুলাই আলিগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন অনুপমা। সব ঠিকই চলছিল।

দেবাশিস পাল

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:০১
আলিগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন সাইকেল বসে দিদিমণি অনুপমা দত্ত।

আলিগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন সাইকেল বসে দিদিমণি অনুপমা দত্ত। নিজস্ব চিত্র।

বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব কিলোমিটার দু’য়েক। আর পাঁচ জনের কাছে সমস্যা না হলেও অনুপমা দত্তের কাছে সে দূরত্ব অনেক। তাঁর দু’টি পা-ই অসাড়। তা বলে দমেননি। বীরভূমের নানুরের আলিগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা অনুপমা গত দু’দশক হুইল চেয়ারে সে দূরত্ব অতিক্রম করে চলেছেন নিয়মিত। বিশেষ ছুটিও নেননি এত বছরে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা না হয়েও অনুপমা সহকর্মীদের কাছে ‘বড়দি’ এবং পড়ুয়াদের কাছে ‘সাইকেল দিদিমণি’। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, হুইল চেয়ার ঠেলে তাঁকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া এবং বাড়িতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পালা করে পালন করেন স্বামী অসীম দত্ত এবং ছেলে কুণাল। তবে এক বার স্কুলে পৌঁছলে, হুইল চেয়ার সামলানোর দায়িত্ব তুলে নেয় ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীরাই।

১৯৯২ সালের ৪ জুলাই আলিগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন অনুপমা। সব ঠিকই চলছিল। কিন্তু ২০০৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ধানবোঝাই গরুর গাড়ি চাপা পড়ে মারাত্মক জখম হন তিনি। শিরদাঁড়ার নিম্নাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অসাড় হয় দু’টি পা। সঙ্গী হয়ে ওঠে হুইল চেয়ার। তখন চাইলে, নিজের গ্রামের ব্রাহ্মণডিহি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু আলিগ্রামের স্কুল ছাড়তে চাননি এই শিক্ষিকা। তাঁর স্বামী অসীম বলেন, “গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ নিলে, হয়তো অনুপমাকে এতটা কষ্ট করতে হত না। কিন্তু ওই স্কুলের প্রতি ওর টান দেখে জোর করিনি।”

কর্মজীবনের তিন দশক পেরিয়ে আগামী বছর অবসর নিতে চলেছেন অনুপমা। পাতু মেটে, অভিজিৎ মেটে, রাখি পাঠকের মতো এলাকার অনেকে আজ অভিভাবক হলেও, অনুপমার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী। তাঁরা বলছেন, “দিদিমণির নিষ্ঠাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।” স্কুলে এই শিক্ষিকার হুইল চেয়ার ঠেলে দেয় নিবেদিতা ঘোষ, দেবব্রত মণ্ডল, অঙ্কুশ ঘোষ, তিতলি মেটের মতো ছাত্রছাত্রীরা। তারা তাদের প্রিয় শিক্ষিকার সাহায্যে আসতে পেরে বেজায় খুশি। স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা চিত্রালি মুখোপাধ্যায় বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবিকা সরকার বলেন, “অনেক কিছুই অনুপমাদির থেকে শেখা। মাতৃস্নেহের স্পর্শ অনুভব করেছি ওঁর কাছে।”

প্রধান শিক্ষক স্বদেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওঁর সময়ানুবর্তিতা ও নিষ্ঠা আমাকে অবাক করে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার চেয়ে ইচ্ছাশক্তি যে অনেক বেশি শক্তিশালী, তার প্রকৃত নজির আমাদের বড়দি।” জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি প্রলয় নায়েকের কথায়, “প্রতিবন্ধকতা নিয়ে উনি যে ভাবে এতগুলো বছর নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, তার প্রশংসার জন্য কোনও শব্দই যথেষ্ট নয়।”

অনুপমা বলেন, “ঈশ্বরের দেওয়া সম্মানে আমি তৃপ্ত। এই প্রতিবন্ধকতা না থাকলে, হয়তো স্কুলের জন্য আরও বেশি কিছু করতে পারতাম আমি। আমরা শিশুমিত্র পুরস্কার পেয়েছি। প্রধান শিক্ষকের পাশে যথাযথ ভাবে দাঁড়াতে পারলে, হয়তো রাজ্যের সেরাও হতে পারতাম!”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Wheel Chair kirnahar

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy