Advertisement
১৯ মে ২০২৪

সকাল থেকে পতাকা হাতে রাস্তায় দু’পক্ষই

রাস্তার দখল নিতে মঙ্গলবার দুই জেলার বেশ কিছু জায়গাতেই বন্‌ধের সমর্থনে বিজেপি আর বন্‌ধের বিরোধিতা করে তৃণমূল মিছিল করেছিল। এ দিনও দু’পক্ষকে রাস্তায় নামতে দেখা গিয়েছে।

কেনাবেচা: বুধবার সকালে বিষ্ণুপুর থানার সামনে চকবাজারে। ছবি: শুভ্র মিত্র

কেনাবেচা: বুধবার সকালে বিষ্ণুপুর থানার সামনে চকবাজারে। ছবি: শুভ্র মিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ট্রেন চলেছে। দু’-একটি রুট বাদ দিলে বেসরকারি বাস পথে নামেনি। সরকারি বাস চললেও যাত্রী ছিল হাতে গোনা। অবরোধ হয়েছে জাতীয় সড়ক-সহ কিছু রাস্তায়। দুই জেলার প্রশাসন জানিয়েছে, সরকারি অফিসে হাজিরা ছিল অন্য দিনের মতোই। বুধবার বিজেপির ডাকা বন্‌ধে মোটের উপরে ছবিটা ছিল এমনই।

রাস্তার দখল নিতে মঙ্গলবার দুই জেলার বেশ কিছু জায়গাতেই বন্‌ধের সমর্থনে বিজেপি আর বন্‌ধের বিরোধিতা করে তৃণমূল মিছিল করেছিল। এ দিনও দু’পক্ষকে রাস্তায় নামতে দেখা গিয়েছে।

বুধবার সাতসকালে বাঁকুড়া শহরে তৃণমূলের মিছিল শুরু হয়। কিন্তু বিজেপিকে মাঠে নামতে বিশেষ দেখা যায়নি। দলের জেলাসভাপতি বিবেকানন্দ পাত্র বলেন, ‘‘বাঁকুড়া শহরে বন্‌ধের সমর্থনে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিছিল হয়েছে। বুধবার ছাতনা, রাইপুর, সারেঙ্গা-সহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা মিছিল করেছি।” জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “সাধারণ মানুষ তো বনধ পালন করছে না। এই পরিস্থিতিতে দলের লজ্জা ঢাকতে বিজেপি নেতারাই নিজেদের ঘরবন্দি করে রেখে বনধ পালন করছেন।’’

বিষ্ণুপুর শহরে উপ-পুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের কাউন্সিলররা বন্‌ধের বিরোধিতা করে মিছিল করেন। বিজেপির বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি স্বপন ঘোষ অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাঁদের সমর্থকেরা শহরে ঢুকতে গেলে মারধর করা হয়। থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল।

সারেঙ্গার সুখাডালি এলাকায় মিছিলে হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। দলের জেলা সভাপতি বিবেকানন্দ পাত্র বলেন, “সুখাডালিতে আমাদের কর্মীরা বন্‌ধের সমর্থনে মিছিল করছিলেন। তৃণমূল হামলা চালায়। দু’জন কর্মী জখম হয়েছেন।” হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় অভিযোগ দায়ের হয়নি।

সকাল থেকে মোটরবাইক এবং তৃণমূলের পতাকা নিয়ে কিছু লোকজনকে পুরুলিয়া শহরের বিভিন্ন বাজারে দোকানপাট খোলাতে দেখা গিয়েছে। নেতৃত্বে ছিলেন তৃণমূলের শহর সভাপতি বৈদ্যনাথ মণ্ডল এবং যুবনেতা গৌতম রায়। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া জাতীয় সড়কের উড়ালপুলে ওঠার মুখে বন্‌ধ সমর্থকদের সঙ্গে বাস আটকানো নিয়ে কিছু লোকজনের ঝামেলা হয়। বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘আমাদের সমর্থকেরা মানুষজনকে বন্‌ধ সফল করার আবেদন জানাচ্ছিলেন। সে সময়ে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাদের মারধর করে।’’

রঘুনাথপুর ২ ব্লকে পথে নেমেছিল বিজেপি। মহকুমার অন্য কোথাও তাদের বিশেষ সক্রিয়তা দেখা যায়নি। আদ্রায় কাশীপুর মোড়ের কাছে বিজেপির যুব মোর্চার একটি অস্থায়ী অফিস মোটরবাইক মিছিল থেকে তৃণমূলের লোকজন ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ। তবে তৃণমূলের আদ্রা শহর সভাপতি ধনঞ্জয় চৌবের দাবি, বিজেপির ওই অফিসে অসামাজিক কাজকর্ম হত বলে স্থানীয় মানুষজনই সেটি ভেঙে দিয়েছেন। সকালে আনড়ায় মিছিল করেছিল বিজেপি। সেই সময়েই পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক দিয়ে যাওয়া একটি ট্রাক থামিয়ে ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ।

ঝালদায় বিজেপির মিছিল হয়েছে। তৃণমূলকে সেখানে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি। বান্দোয়ানে বিজেপি ও তৃণমূল— দু’পক্ষই মিছিল করেছে। মানবাজার এবং বরাবাজার বাসস্ট্যান্ড ফাঁকা ছিল।

সড়কে ভোগান্তি

সকাল ৯টা নাগাদ রাইপুরের সবুজ বাজার এলাকায় বাস আটকাচ্ছিলেন বিজেপি সমর্থকেরা। সেই সময়ে ওড়িশার বারিপদা থেকে বাঁকুড়াগামী একটি বাস সেখানে এসে পড়ে। গোলমালের আশঙ্কায় বাস ছেড়ে চলে যান চালক। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। অবরোধকারীদের সরিয়ে স্টিয়ারিং ধরেন রাইপুর থানার আইসি বিশ্বজিৎ মণ্ডল। বাস চালিয়ে নিয়ে যান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে, রাইপুর পাওয়ার হাউস মোড়ে। ফোন করে ডাকা হয় চালককে। তিনি সেখান থেকে বাস নিয়ে গন্তব্যে রওনা দেন। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাও বলেন, “যাত্রীদের সাহায্য করতেই আইসি এগিয়ে গিয়েছিলেন।”

দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা সূত্রের দাবি, সকালে পুরুলিয়া-বহরমপুর রুটের একটি বাস পুরুলিয়া শহর থেকে বেরিয়ে উড়ালপুলে ওঠার আগে ধোবঘাটা মোড় এলাকায় কিছু লোকজন রাস্তা আটকায়। খুলে দেওয়া হয় বাসের তার। পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কে কুস্তাউরের কাছে বলরামপুর-দুর্গাপুর রুটের একটি বাস অবরোধের জেরে বেশ কিছুক্ষণ আটকে ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে সেটিকে রওনা করায়। সকালে লধুড়কা ও পড়াশিয়া মোড়ে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া (৬০-এ) জাতীয় সড়কে অবরোধ হয়। বন্‌ধ সমর্থকদের মিছিল আর বিক্ষোভের জেরে যান চলাচল ব্যহত হয়েছে পুরুলিয়া-রাঁচী সড়কেও।

ট্রেন পেয়ে নিশ্চিন্ত

বুধবার দুই জেলায় ট্রেন অবরোধ হয়নি। তবে যাত্রী ছিল কম। বেলা ১১টা নাগাদ পুরুলিয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে শহরের বাসিন্দা কবিতা মাহাতো বলেন, ‘‘আসানসোল যাব। বাস তো পেলাম না। ট্রেনটা চলছে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।’’ রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, সাঁতরাগাছিতে অবরোধ হওয়ায় বাতিল করতে হয়েছে শালিমার-ভোজুডি আরণ্যক এক্সপ্রেস। ঘণ্টা তিনেক দেরিতে চলেছে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস। চন্দ্রকোনা স্টেশনে কিছু সময়ের জন্য অবরোধ হওয়ায় দাঁড়িয়েছিল শিরোমণি প্যাসেঞ্জার। বিজেপির পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সামনে পুজো। তাই আমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ট্রেন চলাচলে কোনও বাধা দেওয়া হবে না। কিন্তু তার পরেও ট্রেনে যা যাত্রী দেখা গিয়েছে, তাতেই স্পষ্ট আমাদের বন্‌ধ মানুষ সমর্থন করেছেন।’’

দোকান-বাজার

পুরুলিয়া শহরে কয়েকটি ব্যাঙ্ক খুলেছিল। তবে বেশির ভাগ বাজারেই দোকানপাট ছিল বন্ধ। কাপড়গলি, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, চকবাজার ছিল শুনশান। সকালে বড়হাটের আনাজ বাজারে অবশ্য বেচাকেনা হয়েছে। অল্প কিছু দোকানপাট খোলা ছিল কোটশিলা, জয়পুর, চাষমোড়, বাঘমুণ্ডিতে। বলরামপুরের রাস্তাঘাট ছিল শুনসান। কাশীপুরে বাজার খোলা ছিল। বোরো থানা এলাকায় খড়িদুয়ারা বাজারে দোকানপাট খোলেনি। বরাবাজার, বামুনডিহা, সিন্দরি বাজার প্রায় বন্ধ ছিল। বাঁকুড়া শহরের বাজারে বন্‌ধের তেমন প্রভাব দেখা যায়নি। পুজোর কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলেন অনেকে। বেড়ো গ্রাম বাদ দিয়ে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর মহকুমায় বন্‌ধ কেটেছে নির্বিঘ্নেই। মিশ্র সাড়া পড়েছিল। জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিল রেলশহর আদ্রা, মহকুমাসদর রঘুনাথপুর, কাশীপুর, নিতুড়িয়া ও পাড়ায়। আংশিক প্রভাব পড়েছিল রঘুনাথপুর ২ ও সাঁতুড়ি ব্লকের কিছু এলাকায়।

অফিসে হাজিরা

দুই জেলাতেই সরকারি দফতরগুলিতে কর্মীদের হাজিরা স্বাভাবিক ছিল বলে দাবি করেছে প্রশাসন। এ দিন পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনিক ভবনে গিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো। কর্মীদের অফিসে পৌঁছতে কোনও অসুবিধে হয়েছে কি না, সেই ব্যাপারে খোঁজ নেন তিনি। জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘স্কুল-কলেজ, অফিস সবই খোলা ছিল। হাজিরা ছিল অন্য দিনের মতোই।’’ রঘুনাথপুর মহকুমার শিল্পাঞ্চল নিতুড়িয়া ও সাঁতুড়ির কয়লাখনিগুলিতে কাজ হয়েছে অন্য দিনের মতো। স্পঞ্জ আয়রন ও সিমেন্ট কারখানাগুলিতে হাজিরা ছিল স্বাভাবিক। বাঁকুড়ার শিল্পাঞ্চলেও বন্‌ধের প্রভাব দেখা যায়নি। জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস বলেন, “জনজীবন একদম স্বাভাবিক ছিল।”

ধরপাকড়

বন্‌ধের দিনে ঝামেলা রুখতে দুই জেলার বিভিন্ন জায়গায় পুলিশি পাহারা ছিল। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাও বলেন, “ওন্দা থানা এলাকায় চার জনকে ঝামেলা পাকানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া দিনভর কোনও এলাকা থেকেই ঝামেলার কোনও খবর আসেনি।” পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন বরাবাজার থেকে ৭ জন এবং পুরুলিয়া সদর থেকে ১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

দিনের শেষে

বিজেপির পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘হুমকি ও সন্ত্রাস উপেক্ষা করে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন গণতান্ত্রিক ভাবেই। তৃণমূলের লোকজন আমাদের কর্মীদের কয়েকটি জায়গায় মারধর করেছে। আমাদের কর্মীরা সন্ত্রাস এবং হুমকি উপেক্ষা করেও রাস্তায় ছিলেন।’’ বন্‌ধ সর্বাত্মক ভাবে সফল বলে দাবি করেছেন বিজেপির বাঁকুড়া জেলা সভাপতি বিবেকানন্দ পাত্রও। আর তৃণমূলের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলেন, ‘‘যানবাহন চলেছে। বাজার খুলেছে। মানুষই বন্‌ধ ব্যর্থ করেছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bandh Strike Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE