দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি আঁকড়ে আজও জঙ্গলের মাঝে একলা পড়ে রয়েছে সেই গোপন বিমান ঘাঁটির রানওয়ে নিজস্ব চিত্র
দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। সাল ১৯৩৯। গোটা বিশ্ব জুড়ে তখন যুদ্ধের দামামা। ভারতের মাটিকে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে মরিয়া ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিষ্ণুপুরের অদূরে বাসুদেবপুরের গভীর জঙ্গলে গড়ে তুলেছিল এক গোপন বিমান ঘাঁটি। দীর্ঘ আশি বছর ধরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি আঁকড়ে আজও জঙ্গলের মাঝে একলা পড়ে রয়েছে সেই গোপন বিমান ঘাঁটির রানওয়ে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির আগে পর্যটনের স্বার্থে তা খুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন এলাকার মানুষ।
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে কোতুলপুরের রাস্তার পাশেই বাসুদেবপুর জঙ্গল। এই জঙ্গলের তাতিপুকুর মোড় থেকে আরও ভিতরে যাওয়ার রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে কংক্রিটে বাঁধানো সুদীর্ঘ রানওয়ে। কথিত আছে, আশি বছর আগে বাসুদেবপুর জঙ্গলের ঘনত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। দিনে দুপুরে জঙ্গলে প্রবেশ করতেও ভয় পেতেন মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে গোপন বিমান ঘাঁটি তৈরির জন্য এই ঘন জঙ্গলকেই বেছে নিয়েছিল ব্রিটিশ সেনা। স্থানীয়দের কাজে লাগিয়ে দ্রুত জঙ্গল সাফ করে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তৈরি করা হয় ওই রানওয়ে। স্থানীয়েরা কেউ কেউ বলেন, সেই সময় এই জঙ্গলে শুধু রানওয়ে তৈরি করা হয়নি, তৈরি হয়েছিল লাইট হাউসও। সেনাদের থাকার অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানে। যুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান প্রায়শই ওঠানামা করত ওই রানওয়ে দিয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামতেই ওই বিমান ঘাঁটির প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যায় রানওয়েরব পাশে থাকা লাইট হাউস ও অস্থায়ী সেনা ছাউনি। রোদ-জলে অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে রানওয়ের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফাটল তৈরি হয়েছে। আর সেই ফাটল থেকে মাথা তুলেছে ঝোপঝাড়। মড়ার, বাসুদেবপুর-সহ আশপাশের গ্রামের মানুষেরা এই রানওয়েকে নিজেদের যাতায়াতের পথ হিসাবে ব্যবহার করেন। রানওয়ের কোনও কোনও অংশ ফসল শুকানোর কাজেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রানওয়ের একপ্রান্তে বাসুদেবপুর গ্রাম লাগোয়া এলাকায় সম্প্রতি ভারতীয় বায়ুসেনার তরফে একটি নোটিস টাঙানো হয়। ওই নোটিসে বায়ুসেনার তরফে জানানো হয়েছে, ওই জমি বা সম্পত্তি ভারতীয় বায়ুসেনা তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আওতায় পড়ে। সেখানে যে কোনও ধরনের নির্মাণ ও কৃষিকাজ দণ্ডনীয় অপরাধ বলেও জানানো হয়েছে।
প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিষ্ণুপুরে আসা পর্যটকদের একাংশ এই বিমান ঘাঁটি দেখতে হাজির হন বাসুদেবপুর জঙ্গলে। আরামবাগ থেকে এই রানওয়ে দেখতে আসা পর্যটক পিয়ালি মণ্ডল বলেন, “পরিত্যক্ত এই রানওয়ের কথা আগে জানতাম না। বিষ্ণুপুর বেড়াতে এসে এই জায়গার কথা শুনলাম। ফেরার পথে দেখতে এসেছি। এমনই কত ইতিহাস অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে, কে তার খোঁজ রাখে!” সংলগ্ন মড়ার গ্রামের বাসিন্দা ইকবাল বায়েন বলেন, “দাদুর মুখে শুনেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দিনরাত এই বিমান ঘাঁটিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিমান ওঠানামা করত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই জায়গা ভারতের বায়ুসেনার হয়ে যায়। আমরাও দু’একবার বায়ুসেনার হেলিকপ্টার নামতে দেখেছি। বায়ুসেনার কর্তা এই রানওয়েতে এসে নামেন। রানওয়ে দেখে তাঁরা আবার চলে যান। এই রানওয়ে সংরক্ষণ করে পর্যটকদের জন্য খুলে দিলে এলাকার পর্যটন নতুন দিশা পেত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy