এ এক বিচিত্র অবস্থা! চলতি বছরে রাজ্যে আলুর ব্যাপক ফলন হওয়ায় কোথাও হিমঘরে আলু রাখতে না পেরে চাষিরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। আর পুরুলিয়া জেলায় হিমঘর থেকেও বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।
বান্দোয়ানের লিকি গ্রামে ‘বান্দোয়ান সাউথ ল্যাম্পস’ পরিচালিত হিমঘরটি ২০০৬ সালে চালু হয়েছিল। কিন্তু দেনার দায়ে ল্যাম্পস কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে হিমঘরটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মানবাজারের পাথরকাটায় ২০০৯ সালে ‘মানভূম হিমঘর সমবায় সমিতি’র নামে একটি হিমঘর চালু হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও আশানুরূপ আলু না আসায় বছর তিনেক চালানোর পর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন কর্তপক্ষ। তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে হিমঘরটি ফের চালু হয়েছে। কিন্তু মোটা দেনা থাকায় ওই হিমঘরও কতদিন চালু রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় কাটেনি।
পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান, মানবাজার, বাঘমুণ্ডি, আড়শা, কোটশিলা, পুঞ্চা, কাশীপুর প্রভৃতি এলাকায় অল্পস্বল্প জমিতে আলু চাষ হয়। ওইসব এলাকার সঙ্গেই পড়শি জেলা থেকেও আলু আসবে আশা করে হিমঘর দু’টি খোলা হয়েছিল। আলুর সঙ্গেই হিমঘরে আলাদা জায়গায় সব্জি সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু দু’টি ক্ষেত্রেই লাভ হয়নি। বান্দোয়ান সাউথ ল্যাম্পসের ম্যানেজার মাধব সিংয়ের কথায়, ‘‘এলাকায় যে আলু ওঠে তা বাদ দিয়েও বাইরে থেকে আলু আসবে বলে আমরা ভেবেছিলাম। কিন্তু বাইরের জেলা থেকে আমাদের হিমঘরে আলু ঢোকেনি। ফলে হিমঘর কোনও বছরই পুরো ভর্তি হয়নি। কিন্তু হিমঘর ভর্তি থাকলে সমিতি লাভের মুখ দেখত।’’ তাঁর আক্ষেপ, ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তাঁরা হিমঘর চালু রেখেছিলেন। কিন্তু হিমঘরটি একবারও ভর্তি হয়নি। অথচ হিমঘর চালু রাখার খরচও কম নয়। বিদ্যুতের খরচ তো বটেই, কর্মচারীদের বেতনের খরচও রয়েছে। নাগাড়ে কয়েকবছর ধরে লোকসানে চালিয়ে তাই তাঁরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তিনি জানান, এখন ওই হিমঘরের জন্য দেনার পরিমাণ সুদে-আসলে ১ কোটি টাকার ছাপিয়ে গিয়েছে। ন্যাশনাল কো-অপারেটিভ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনসিডিসি), ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাইবাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেটিভ কর্পোরেশন, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর প্রভৃতি দফতর থেকে ঋণ নিয়ে হিমঘর চালু করা হয়েছিল। ঋণ থেকে মুক্তি পেতে সমিতি হিমঘর বিক্রি অথবা লিজে দিতে চেয়ে আবেদন পর্যন্ত জানিয়েছিলেন। সম্প্রতি আদিবাসী উন্নয়ন নিগম ও অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ বিভাগের রাজ্য ও জেলাস্তরের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল হিমঘর পরিদর্শন করে গিয়েছেন। কিন্তু সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার দিশা এখনও মেলেনি।
বান্দোয়ানের হিমঘরে ৬০০ মেট্রিক টন আলু এবং ২৭৫ টন সব্জি রাখার প্রকোষ্ঠ রয়েছে। সমিতি জানিয়েছে, ২০০৮ সালে প্রকোষ্ঠের ৮০ ভাগ ভর্তি হয়েছিল । সে বছরই সমিতি খানিকটা লাভের মুখ দেখে। বাকি সময়টা লোকসানেই চলেছে। কোনও সময়েই সব্জি প্রকোষ্ঠে মাল ঢোকেনি। আদিবাসী উন্নয়ন সমবায় নিগমের জেলা আধিকারিক স্বপনকুমার পাল অবশ্য বান্দোয়ানের হিমঘরটি ফের চালু করা যাবে বলে আশা রাখেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন স্তরে এই নিয়ে কথা বলছি। কী ভাবে হিমঘরটির পুনরুজ্জীবন করা যায়, সব রকম ভাবে আমরা সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই হিমঘরটি চালু না হলে ভুল বার্তা যাবে।’’
মানবাজারের পাথরকাটা গ্রামে মানভূম হিমঘর সমিতির অফিস রয়েছে। ওই হিমঘরের ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৬০০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সব্জির জন্য ৯০ মেট্রিক টন বরাদ্দ রযেছে। সমিতির ম্যানেজার বিশ্বনাথ মল্লিক বলেন, ‘‘চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমরা আশানুরূপ আলুর জোগান পাইনি। তাই ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হিমঘরটি বন্ধ রাখা ছিল। হিমঘর চালু করতে না পারলে মেশিনের কলকব্জায় জং ধরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সম্প্রতি জেলা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর উদ্যোগে ফের হিমঘরটি চালু করা হয়েছে। কিন্তু চাষিরা আলু বিশেষ মজুত করেননি। ফলে কতদিন হিমঘর চালু রাখা যাবে তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েই গিয়েছে।’’
মানভূম হিমঘর সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, এই হিমঘর তৈরির জন্য সরকারি অনুদান তারা পায়নি। ২০০ জন শেয়ার হোল্ডার হিমঘর নির্মাণের খরচ জুগিয়েছেন। খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকা। পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই জেলায় আলু চাষ পর্যাপ্ত না হলেও সব্জি খারাপ চাষ হয় না। বহুমুখি দু’টি হিমঘরে চাষিরা আলুর সঙ্গে সব্জীও রাখতে পারতেন।’’ তবে দুই হিমঘরের তরফেই দাবি করা হয়েছে, প্রশাসন বাড়তি উদ্যোগ নিলে হিমঘর দু’টিতে আলু ও সব্জি রাখায় চাষিদের আগ্রহ বাড়বে। পাশাপাশি হিমঘরে নানা ভাবে বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy