Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

লক্ষ্যের দিকে প্যাডল জাসমিনের

ক্রিকেট, ফুটবলের মতো না হলেও সাইক্লিং জনপ্রিয় হতে শুরু করে বিশ শতকে। এই স্পোর্টস এখন তুমুল জনপ্রিয় ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি এবং নেদারল্যান্ড-এ। সাইক্লিংএখন এটি অলিম্পিক স্পোর্টসও বটে। সদ্য সমাপ্ত প্যারা অলিম্পিকে সাইক্লিংয়ের সময়েই পাহাড়ি রাস্তায় পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় ইরানের বাসিন্দা বছর আটচল্লিশের বাহমান গোলবারনেজাদ-এর।ওর কোনও ‘খিদ্দা’ এখনও নেই। যিনি ধরিয়ে দেবেন ভুল-ত্রুটি। দেখতে শেখাবেন স্বপ্ন। দিন-আনা দিন খাওয়া সংসারে যখন দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগারেই প্রানান্ত, তখন অনুশীলনের পরে ডিম-দুধ, কলা জোগাবে কে?

রানিগঞ্জ–মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে চলছে অনুশীলন। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।।

রানিগঞ্জ–মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে চলছে অনুশীলন। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
নলহাটি শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০২:২২
Share: Save:

ওর কোনও ‘খিদ্দা’ এখনও নেই। যিনি ধরিয়ে দেবেন ভুল-ত্রুটি। দেখতে শেখাবেন স্বপ্ন। দিন-আনা দিন খাওয়া সংসারে যখন দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগারেই প্রানান্ত, তখন অনুশীলনের পরে ডিম-দুধ, কলা জোগাবে কে? নেই অনুশীলনের উপযুক্ত রাস্তা। ‘পাশে আছি, লড়ে যা’ বলে কেউ সে ভাবে পিঠ চাপড়ে দেয়নি ওর। পাওয়া বলতে একটি রেসিং সাইকেল। তা নিয়েই স্বপ্ন-উড়ানে সওয়ার নলহাটির প্রত্যন্ত ভেলিয়ান গ্রামের বছর আঠারোর জাসমিন খাতুন। নিজের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছে নিজের কাছেই— রেসিংয়ে জাতীয় স্তরের পদক।

পাঁচ শতক জায়গার উপরে পাঁচ ভাইয়ের পাঁচটা ঘর। সেই ভাগের ঘরের একটায় কোনও রকম ভাবে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে থাকেন ভ্যানচালক সিরাজুল ইসলাম। টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরটা থেকে এক চিলতে বারান্দা পেরিয়ে নামতে গেলেই কাদায় মাখামাখি হয়ে যায় পা। বর্ষাকাল কিনা! বাড়ি থেকে সামনে গলির রাস্তা ধরে পাঁচশো মিটার দূরে রানিগঞ্জ–মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক। সেখানে উঠলে তবে মেলে সাইকেল চালানোর অবসর। মুহূর্তে প্যাডেলে পা দিয়ে দুদ্দাড় গতিতে ছুটে চলা...। পাশ দিয়ে হু হু করে চলে যাচ্ছে গাড়ি। এমন করে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা। সঙ্গী কেবল এক বোতল জল।

বেশ কয়েক মাস হল এটাই রুটিন। কখনও জাতীয় সড়ক ধরে ৫০ কিলোমিটার দূরের পথ বহরমপুর। তো কখনও ৩৫ কিলোমিটার দূরের রামপুরহাট। হু হু করে ছুটে চলা। ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফেরা। তারপরে খাবার বলতে দু’মুঠো ভাত। সঙ্গে থাকে কোনও দিন আলু সেদ্ধ কোনও দিন শুকনো তরকারি। কেন? জাসমিনের জবাব, ‘‘জুটবে কোত্থেকে? তিন বোন। তিন জনেই পড়াশোনা করি। বাবা ভ্যান চালিয়ে যেটুকু রোজগার করে। পুষ্টিকর খাবার আসবে কোথা থেকে?’’ থাকার মধ্যে আছে কেবল রেসিং সাইকেল। সম্প্রতি ওয়েস্ট বেঙ্গল সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের তরফে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে অনুশীলনের জন্যে ওই সাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছে।

জাসমিনের যে আরও অনেক কিছু জরুরি তা মানছেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বীণা ঘোষ। তিনি মনে করেন, ‘‘জাতীয় মঞ্চে ভাল কিছু করার ক্ষমতা ওর আছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। ওর উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, ওজন ৬৪ কেজি। এ সবই ওর পক্ষে রয়েছে। প্রয়োজন শুধু তালিম আর জোরদার অনুশীলন। আর জরুরি খাবার।’’ অভিজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মেয়েটি যেমন পরিশ্রম করে তাতে ওর প্রতিদিনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন জরুরি। তবে খুব কষ্ট করে হলেও দিনে একটা করে ডিম জাসমিনের পাতে দেওয়ার চেষ্টা করে ওর পরিবার।

পরিজনেরা জানাচ্ছেন, ছোটবেলা থেকেই জাসমিনের খেলাধুলোর প্রতি ঝোঁক। এখন সে কয়থা হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলের খেলাধুলোর প্রশিক্ষক স্বপন লেট জানান, ক্লাস এইটে পড়ার সময় জাসমিন প্রথম খেলায় যোগ দেয়। খুব ভাল ফল করেছিল। জাসমিন যোগ করছে, স্যারের প্রশিক্ষণেই স্কুলের ছুটিতে, টিফিনের ফাঁকে শর্টপার্ট, ডিসকাস থ্রো, জ্যাভলিন চালিয়ে যাওয়া। ওই খেলাগুলোর সাফল্য থেকেই জেলা পেরিয়ে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় যোগ দিই। এ বছরই জ্যাভলিন-এ সে রাজ্যে তৃতীয় হয়েছে। সেই প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার পরেই আসে পরিবর্তন। জাসমিনের কথায়, ‘‘এত দিন যা যা করছিলাম তাতে ঠিক যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, আমার জন্যে অন্য কিছু ঠিক হয়ে রয়েছে। রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় সাইক্লিস্টেরা যোগ দিয়েছিল। ওদের দেখার পরেই বুঝে যাই এত দিন যার সন্ধানে ছিলাম তা পেয়ে গিয়েছি।’’

তারপর থেকেই শুরু হয়েছে জোর অনুশীলন। প্রথমে বাবার ভাঙা সাইকেলে। গ্রামের রাস্তাতেই চলেছিল চর্চা। দু’একবার সাহস করে উঠে পড়েছিল জাতীয় সড়কেও। সেই তালিম থেকেই যোগ দেয় প্রথম সাইকেল রেসিং প্রতিযোগিতায়। সম্প্রতি ‘বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত পঞ্চম নেতাজি সুভাষ জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাইক্লিংয়ের তিনটি ইভেন্টে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে জাসমিন। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত ৩৬তম রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় দুটি ইভেন্টে প্রথম হয় জাসমিন। কেরালায় অনুষ্ঠিত সাইক্লিং ফেডারেশন আয়োজিত ২০ তম রোড সাইক্লিং চ্যাম্পিয়নশিপে জুনিয়র বিভাগে কোয়ালিফাই করেছে এই অষ্টাদশী। এরপরেই নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছে সে— ডিসেম্বরে ত্রিবান্দ্রমে অনুষ্ঠিত জাতীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় পদক।

জাসমিনকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন বাবা-মাও। আত্মবিশ্বাসী গলায় বাবা সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ‘‘দেখবেন ও ঠিক পারবে।’’ বছর আঠারোর মেয়ে এ ভাবে একের পর এক সাফল্য পাচ্ছে দেখে উৎসাহ দিচ্ছেন প্রতিবেশীরাও। এলাকার বাসিন্দা প্রবীর হোসেন, আলাউল হক, কালিদুল্লা শেখরা বলছেন, ‘‘ও এগিয়ে যাক। আমরা পাশি আছি।’’ নিজের সাধ্য মতো সাহায্য করছেন স্কুলের প্রশিক্ষক স্বপনবাবুও।

সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন রামপুরহাটের মহকুমাশাসক সুপ্রিয় দাসও। তাঁর কথায়, ‘‘এমন প্রতিভা হারাতে দেওয়া যায় না।’’ একই আশ্বাস মিলেছে সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বীণাদেবীর তরফেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jasmine khatun Cycling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE