Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মন্ত্রীর নালিশের পরেও বদলায়নি পরিস্থিতি

জ্বলছে জঙ্গল, পালাচ্ছে জন্তুরা

সবুজ জঙ্গলের মাথায় পাক দিয়ে উড়ছে কালো ধোঁয়া। শালগাছের সবুজ পাতা ঝলছে গিয়েছে। নীচে ঝরে পড়া শুকনো পাতা হু হু করে জ্বলতে জ্বলতে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে জীবজন্তু। জঙ্গলে যাঁরা গরু, ছাগল চরাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, আতঙ্কে তাঁরাও গবাদি পশুদের নিয়ে ফিরে আসছেন।

লেলিহান:  বিষ্ণুপুর রেঞ্জের চুয়াশোল গ্রামের বিস্তীর্ণ শাল জঙ্গলে পুড়ে যাচ্ছে। শনিবার। বন দফতর জানিয়েছে, কারা আগুন লাগাচ্ছে, খোঁজ চলছে। ছবি: শুভ্র মিত্র

লেলিহান:  বিষ্ণুপুর রেঞ্জের চুয়াশোল গ্রামের বিস্তীর্ণ শাল জঙ্গলে পুড়ে যাচ্ছে। শনিবার। বন দফতর জানিয়েছে, কারা আগুন লাগাচ্ছে, খোঁজ চলছে। ছবি: শুভ্র মিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৮ ০২:০৮
Share: Save:

সবুজ জঙ্গলের মাথায় পাক দিয়ে উড়ছে কালো ধোঁয়া। শালগাছের সবুজ পাতা ঝলছে গিয়েছে। নীচে ঝরে পড়া শুকনো পাতা হু হু করে জ্বলতে জ্বলতে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে জীবজন্তু। জঙ্গলে যাঁরা গরু, ছাগল চরাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, আতঙ্কে তাঁরাও গবাদি পশুদের নিয়ে ফিরে আসছেন। শনিবার সকালে এমন ছবিই দেখা গেল, বিষ্ণুপুর রেঞ্জের চুয়াশোল গ্রামের বিস্তীর্ণ শাল জঙ্গলে।

জঙ্গলে অগ্নিকাণ্ডের জেরে শুরু পশুপাখিদেরই জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে এমনটা নয়, আগুনে পুড়ে নষ্ট হয় প্রচুর গাছপালারও। বন দফতরের অনুমান, দুষ্কৃতীরা আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে।

শীতকালে জঙ্গলে দুষ্কৃতীরা এ ভাবে আগুন লাগিয়ে দেয় বলে সম্প্রতি জেলা সফরে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই বিষয়টি তুলে উদ্বেগপ্রকাশ করেন কোতুলপুরের বিধায়ক তথা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা। সে দিন শুশুনিয়ার পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগানো হয়েছিল বলে মন্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন।

ডিএফও (বিষ্ণুপুর পাঞ্চেত) নীলরতন পান্ডা বলেন, ‘‘দু্ষ্কৃতীদের জঙ্গলে আগুন দেওয়া দক্ষিণবঙ্গের একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বার এক মাস আগে শিকার ও জঙ্গলে আগুন লাগানো বন্ধ করার ব্যাপারে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে নিয়ে বৈঠক হয়। কিন্তু এত বড় জঙ্গল রক্ষা করতে সবার সাহায্যের প্রয়োজন।’’ তিনি জানান, জঙ্গলের আগুন নেভানোর জন্য পাঁচটি রেঞ্জে বিশেষ যন্ত্র কেনা হয়েছে।

কিন্তু তার পরেও জঙ্গলে আগুন লাগানোর ঘটনা থেকে বন্ধ হয়নি, এ দিন ফের তা দেখা গেল বিষ্ণুপুরে। ওই এলাকা বাগডোবা বন সুরক্ষা কমিটির অধীনে।

কমিটির সম্পাদক কালোমোহন সোরেন, অশোককুমার দে বলেন, ‘‘১৪৫ হেক্টর বন আমাদের কমিটির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সদস্য মোটে ৮২ জন। তাই দুষ্কৃীতদের তাণ্ডব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি।’’

স্থানীয় বাসিন্দা রাধানাথ মাণ্ডি, বাবলু হেমব্রমদের অভিযোগ, ইতিমধ্যে হাতগাড়া, বেলশুলিয়া, চুয়াশোল, বাসুদেবপুর, ত্রিবঙ্ক-সহ বিভিন্ন এলাকার জঙ্গলে দুষ্কৃতীরা আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে বড় বড় শাল, সেগুন, বহড়া গাছ। আতঙ্কে ছোটা ছুটি করছে বনের খরগোশ, মুরগি, শুয়োর। পুড়ে মরছে বহু পশু ও পাখি।

কারা, কেন জঙ্গলে আগুন দিচ্ছে? গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, আগুন দিতে পারে বনের চোরা শিকারি আর গরু, বাছুর নিয়ে জঙ্গলে চরাতে যাওয়া কিছু রাখাল। জঙ্গলে আগুন দিয়ে নিরাপদ জায়গায় জাল বিছিয়ে রাখছে চোরা শিকারিরা। প্রাণ ভয়ে দৌড়ে আসা বন্য প্রাণী সেই জালে ধরা পড়ছে। গোপনে সেই সব জন্তু বিভিন্ন বাজারে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর কিছু রাখাল নিছক মজা করতে শুকনো পাতায় আগুন লাগিয়ে দেয়।

এ দিকে, জঙ্গলের শুকনো পাতা পুড়ে নষ্ট হওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন লাগোয়া এলাকার বাসিন্দারা। যেমন মালতি সোরেন, লক্ষ্মী সোরেন, পানু সোরেনরা শাল পাতা কুড়িয়ে সারা বছরের জ্বালানি জমিয়ে রাখেন। এ ছাড়া কচি শালপাতা একটু বড় হলে তা সংগ্রহ করে তাঁরা থালা তৈরি করেন। সে সবের সর্বনাশ হয়ে গেল বলে তাঁরা আক্ষেপ করছিলেন।

বাগডোবা গ্রামের অশোক দে-র দাবি, দিন চারেক আগে এক রাতে তিনি ঘোষের বাঁধের পাড়ে আগুন নেভাতে গিয়ে পায়ে চোট পান।

বাগডোবা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামচাঁদ মুর্মু বলেন, ‘‘জঙ্গল আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। গাছ আমাদের দেবতা। জঙ্গল না থাকলে আমরা কেউ সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারব না। এই বোধ যত দিন না সবার মধ্যে জাগছে, এই দুষ্কর্ম ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।’’

বাসিন্দারে মতে, প্রতি বছর এই সময়ে বন দফতর একটু সক্রিয় হয়ে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে এ নিয়ে সচেতনতার শিবির করলে মন্দ হয় না।

বাগডোবা প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শুভম সোরেন, কবিতা হেমব্রম বলে, ‘‘বনে ধোঁয়া দেখলে আমাদের খুব ভয় লাগে। বইয়ে পড়েছি, বনে কত পশু-পাখি থাকে। ওদের জন্য কষ্ট হয়।’’

বিষ্ণুপুরের রেঞ্জ অফিসার শ্যামসুন্দর করশর্মা স্বীকার করেন, ‘‘এই এক জায়গায় আগুন নিভিয়ে এলাম তো, পরক্ষণেই আরেক জায়গা থেকে আগুন লাগার খবর আসছে। এরই মধ্যে শুক্রবার রাতে একটি দাঁতাল ঢুকেছে বাসুদেবপুরে। পরিস্থিতি যা রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে।’’

তিনি জানান, বন দফতর পোস্টার সাঁটিয়ে, মাইকে প্রচার করে বনে আগুন লাগানো বন্ধ করতে অনুরোঝ জানিয়েছেন। ধরা পড়লে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিল বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু দুষ্কৃতীদের থামানো যাচ্ছে না।

বন দফতর সূত্রে খবর, বিশেষ বাহিনি গড়ে নজরদারি শুরু হয়েছে। জঙ্গলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হাতে-নাতে ধরা পড়লে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দেওয়া হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jungles Burnt Animals
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE