পড়াশোনা শেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পেশা বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মাথায় চেপে বসেছিল বাগান করার নেশা। বিশেষ দুর্বলতা ছিল আম চাষের প্রতি। ঝুঁকি নিয়েই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পেশা ছেড়ে বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের পাকতোড় গ্রামের বাসিন্দা নিত্যানন্দ গরাই নেমে পড়েছিলেন কোমর বেঁধে। সফলও হয়েছেন। নিত্যানন্দ গরাইয়ের বাগানে এখন ফলছে ১২৫ রকমের আম। দেশের বাজার ছাড়িয়ে এ বার বিদেশের বাজারে রফতানির পথে নিত্যানন্দর বাগানে উৎপাদিত আম।
বাঁকুড়ার বিখ্যাত মল্লিকা ও আম্রপালি প্রজাতির আম তো আছেই। বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের পাকতোড় গ্রামে নিত্যানন্দ গরাইয়ের বাগানে গেলে দেখা মিলবে সার দিয়ে লাগানো গাছে ঝুলছে বিভিন্ন আকারের ও বিভিন্ন রঙের আম। সেই তালিকায় দেশি পুষা, অরুণিকা, মহারাজা, দশেরি, ন্যাংড়া, গোপালভোগ, জরদালু, নিলাম্বরী, কেশর প্রজাতি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে জাপানের মিয়াজ়াকি, ইন্দোনেশিয়ার ব্ল্যাক স্টোন, আমেরিকার রেড পালমার ও নাম ডক মাই, তাইল্যান্ডের কিং অফ চাকাপাথ, থাই ব্যানানা, থাই ফোর কেজি, কিউ জ়াই-সহ অসংখ্য বিদেশি প্রজাতির আম। নিত্যানন্দর দাবি, সব মিলিয়ে সাড়ে আট বিঘা জায়গার উপরে থাকা তাঁর বাগানে ১২৫ প্রজাতির প্রায় সাড়ে পাঁচশো আম গাছ আছে। মাত্র কয়েক বছরে নিত্যানন্দর আম বাগান বাঁকুড়ায় এমন খ্যাতি পেয়েছে যে, শুধু আমের মরসুমে নয়, বাগান দেখার লোভে সেই বাগানে সারা বছরই মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে।
নিত্যানন্দর এই বাগান একদিনে তৈরি হয়নি। ২০১৫ সালে মানকরের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে নিত্যানন্দ বেছে নিয়েছিলেন নির্মাণ ব্যবসা। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই করোনার প্রথম ঢেউয়ে ধাক্কা খায় নির্মাণ ব্যবসা। এই সময়ই মাথায় চেপে বসে বাগান করার নেশা। পৈতৃক সূত্রে গ্রামের অদূরে থাকা সাড়ে আট বিঘা জমির উপর বাগান গড়ার কাজে হাত লাগান তিনি। বিশেষ গুরুত্ব পায় আম চাষ। কখনও বাঁকুড়া জেলা উদ্যান পালন দফতরের সাহায্য নিয়ে, আবার কখনও একক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন নার্সারি অথবা আমদানি রফতানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি-দু’টি করে প্রজাতির আমের চারা সংগ্রহ করতে শুরু করেন নিত্যানন্দ। শুধু চারা সংগ্রহ করলেই হয় না, রীতিমতো সেই প্রজাতির পরিচর্যার সাতসতেরো জেনে নিজে হাতে সেই চারা বসান বাগানে। এ ভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নিত্যানন্দর সাধের আমবাগান। বর্তমানে দিনের একটা বড় অংশ তাঁর কাটে বাগানে গাছের পরিচর্যায়। নিত্যান্দ গরাই বলেন, ‘‘বাবার কাছেই গাছকে ভালবাসতে শিখেছিলাম। বাড়িতে বাগান করা দিয়ে হাতেখড়ি। আজ আমার স্বপ্নের বাগান তৈরি হয়েছে। এখনও কোথাও নতুন প্রজাতির আমের সন্ধান পেলেই সেখানে ছুটে যাই। কলম করে নিজের বাগানে এনে বসানোর চেষ্টা করি। বিভিন্ন সময় চারা আনিয়েও বাগানে বসাই। আমের পাশাপাশি বর্তমানে পেয়ারা, মুসাম্বি, নাগপুর কমলা ও ড্রাগন ফ্রুটের চাষও শুরু করেছি।’’
গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে নিত্যানন্দর বাগানে উৎপাদিত আমের বাজারও বড় হয়েছে। এ রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে দিল্লির আম মেলাতে রীতিমতো সুনাম কুড়িয়েছে নিত্যানন্দর বাগানে উৎপাদিত আম। তা ছাড়াও আশপাশের রাজ্যের বাজারগুলিতেও প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আম পাঠান নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দর দাবি, ‘‘আমার বাগানে মুকুল থেকে আমের গুটি আসার পরেই বিশেষ এক ধরনের কাগজের মোড়ক দিয়ে গুটি মুড়ে ফেলা হয়। এতে আমের রঙ যেমন ভাল থাকে, তেমনই কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। কীটনাশকহীন হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় বাজারে আমার বাগানে উৎপাদিত আমের চাহিদা প্রবল। ক্রেতারা বাগানে এসে ঝুড়ি ঝুড়ি আম কিনে নিয়ে যান। তা ছাড়া আশপাশের রাজ্য ও দিল্লির বাজারগুলিতেও আমার বাগানের আমের ভাল চাহিদা রয়েছে। চলতি বছর কলকাতার একটি রপ্তানিকারী সংস্থা জাপান ও তাইল্যান্ডে পরীক্ষামূলক ভাবে আমার বাগানের আম নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।’’