স্তম্ভিত: বাড়ির দাওয়ায় বসে শিশুপালের ঠাকুমা দুলালী সহিস। ছবি: সুজিত মাহাতো
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কয়েকটা মাটির ঘর। টালির চাল। মাঝের উঠোনে তুলসী মঞ্চ। ফাঁকে দু’টি গেরুয়া পতাকা গোঁজা। চারদিকে থিকথিক করছে পুলিশ। যাদব সহিসের চোয়াল শক্ত। পুলিশের এক বড়কর্তা তাঁকে বললেন, ‘‘ময়নাতদন্তটা তাড়াতাড়ি করা দরকার। আর আপনাদের একটু থানায় যেতে হবে।’’ দাওয়ায় একা বসেছিলেন যাদববাবুর মা দুলালী সহিস। বয়স নব্বই পেরিয়েছে। বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘‘ছেলেটাকে কোলেকাঁখে বড় করলাম। কী করে হল হঠাৎ এমনটা?’’
বৃহস্পতিবার আড়শার সেনাবনা গ্রামে বিজেপির পঞ্চায়েত সদস্য যাদব সহিসের ছেলে বছর তেইশের শিশুপাল সহিসের দেহ উদ্ধার হয়েছে খালের পাশের গাছ থেকে। লোকসভা ভোটের আগে, বিজেপি প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন সকালেই এই খবরে শোরগোল পড়েছে পুরুলিয়ায়। উঠে আসছে পঞ্চায়েত ভোটের আগে ত্রিলোচন এবং দুলাল-কাণ্ডের প্রসঙ্গ। ঘটনায় বিজেপি নিশানা করছে তৃণমূলকে।
বিজেপির পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো সিবিআই তদন্ত দাবি করেছেন। তবে তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, এই ঘটনায় দলের কোনও যোগ নেই। তাঁরাও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করছেন বলে জানিয়েছেন।
পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়া জানান, অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড দেহটির ময়নাতদন্ত করেছে। পুরো প্রক্রিয়ার ভিডিয়ো রেকর্ড করা রয়েছে।’’ তবে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত শিশুপালের পরিবারের তরফে থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
যাদববাবু প্রান্তিক চাষি। গত ভোটে স্থানীয় শিরকাবাদ পঞ্চায়েতে বিজেপির টিকিটে জিতেছেন। শিশুপাল কলকাতায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ছিলেন সেজ। তিন দিদি। তিন জনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মা বিপুলা সহিস কোনও কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। গ্রামের পরিবেশ থমথমে। পরিজনেরা জানাচ্ছেন, শিশুপাল বাড়ি ফিরেছিলেন দিন দশ-বারো আগে। বুধবার সকালেও পাড়ায় দেওয়াল লিখেছেন। দুপুরে বাড়ি এসে খেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বিকেলের পরে খোঁজ মিলছিল না। মোবাইলও বন্ধ। পড়শি উত্তমকুমার মাহাতো, বাদলচন্দ্র কুমাররা বলেন, ‘‘রাতে যতটা পারি খোঁজ খবর করেছিলাম। সকালে খবরটা পেলাম।’’
যাদববাবু আগে সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। গত ভোটে বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়ে পঞ্চায়েতে জিতেছেন। তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে খুন করা হয়েছে শিশুপালকে। তিনি বলেন, ‘‘আমি বোকারোয় একটা অনুষ্ঠান বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল বুধবার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ। তার পরে ফোন বন্ধ।’’ পাশেই বর্ধিষ্ণু গ্রাম হেঁসলা। সেখানে মেলা চলছে। ছো নাচের অনুষ্ঠান ছিল বুধবার। গোড়ায় পরিজনেরা ভেবেছিলেন শিশুপাল সেখানে গিয়েছেন।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, যাননি। বাংলা বছর শুরুর এই সময়টায় গ্রামেগঞ্জে অনেক জায়গায় মেলা বসে। অনেকেই রাতভর মেলায় কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফেরেন। সেই সব ভেবে রাতে আর পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি বলে দাবি যাদববাবুর। সকালে খবর আসে, গ্রাম থেকে আলপথে প্রায় আধ কিলোমিটার হেঁটে গেলে খালের পাশে যে জঙ্গলটা পড়ে, সেখানে ছেলের ঝুলন্ত দেহ দেখা গিয়েছে।
দুপুরে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন যাদববাবু। বললেন, ‘‘ছেলের আর আমার আজই গ্রাম থেকে একসঙ্গে বাসে চড়ে পুরুলিয়ায় আসার কথা ছিল। ঠিক ছিল, মনোনয়নের মিছিলে হাঁটব। কিন্তু আজ এখানটায় এমন ভাবে এসে দাঁড়াতে হবে, সেটা স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy