Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বিড়ির ছ্যাঁকায় খুন, অভিযুক্ত তবু অধরাই

পড়শি এক পরিবার তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনেছিল। খুনের হুমকিও দিয়েছিল। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মিলেছিল বছর বারোর সুরজিৎ বাগদির ঝুলন্ত দেহ। তখন তাকে চেনাই দায়— সারা দেহে বিড়ির ছ্যাঁকা, মারধরের দাগ। দড়ি দিয়ে বাধার চিহ্ন পায়ে!

শাস্তির দাবিতে ফ্লেক্স গ্রামে। ছবি: অনির্বাণ সেন।

শাস্তির দাবিতে ফ্লেক্স গ্রামে। ছবি: অনির্বাণ সেন।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৬ ০০:২৩
Share: Save:

পড়শি এক পরিবার তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনেছিল। খুনের হুমকিও দিয়েছিল। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মিলেছিল বছর বারোর সুরজিৎ বাগদির ঝুলন্ত দেহ। তখন তাকে চেনাই দায়— সারা দেহে বিড়ির ছ্যাঁকা, মারধরের দাগ। দড়ি দিয়ে বাধার চিহ্ন পায়ে! তদন্তকারী পুলিশ কর্তার মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘পরিস্থিতি এমন ছিল যে সিউড়ি হাসপাতালে ময়না-তদন্ত করানো যায়নি, বর্ধমান মেডিক্যালে পাঠাতে হয়।’’ ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বরের সেই ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে আট মাস। অভিযুক্তদের শাস্তি তো দূর, এখনও অধরা মূল অভিযুক্তই!

মহম্মদবাজারের ডামড়া গ্রামের ওই ঘটনা জানাজানি হতেই গা ঢাকা দেন মূল অভিযুক্ত কার্তিক বাগদি ও তাঁর পরিবার। মৃতের পরিবারের অভিযোগ ছিল, প্রতিবেশী কার্তিক বাগদি ও তাঁর কাকার ছেলে বাপ্পা পরিবার টাকা চুরির অভিযোগ এনে ঘটনার আগের দিন সুরজিতকে তার বাড়িতেই মারধর করে। সুরজিতের দিদি অপর্ণার দাবি ছিল, ‘‘মারধর করে চলে যাওয়ার সময়ে ওরা ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরদিনই গ্রামের বাইরে জয়সাগর ও ভাড়কাটিয়া নামে দু’টি পুকুরের মাঝের পাড়ের একটি কদম গাছে ওর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়।’’

ডামড়া গ্রামের পিরু বাগদির দুই সন্তান, অপর্ণা ও সুরজিৎ। মেয়ে নবম ও ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। ঘটনার আগের দিন গ্রামে কানাঘুসো শোনা যায়, সুরজিৎ প্রতিবেশী কার্তিকের বাড়ি থেকে টাকা পয়সা চুরি করেছে। কথাটা কানে আসার পরেও সে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি পিরুবাবু। ওই দিনই নবান্ন উপলক্ষে শ্বশুর বাড়ি চলে যান তিনি। ছেলেমেয়ে বাড়িতেই ছিল। তখনই মারধর করা হয়।

দেহ উদ্ধারের পরে পরিবারের তরফে কার্তিক, তাঁর বাবা আকাল বাগদি, কাকা সনৎ বাগদি ও সনতের দুই ছেলে বিশু ও বাপ্পার বিরুদ্ধে মহম্মদবাজার থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। খুন, সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে তদন্তও শুরু করে পুলিশ। ঘটনার ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিটও জমা পড়ে।

এলাকাবাসীর একাংশের প্রশ্ন, মূল অভিযুক্তের ধরা না পড়া এবং বাকি অভিযুক্তদের জামিনে মুক্তি কি পুলিশের গাফিলতিকেই দায়ী করে না? মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্তা প্রীতম রায় এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য গাফিলতি মানতে চাননি। তাঁর দাবি, পলাতক দুই অভিযুক্ত কার্তিক এবং বিশুর বিরুদ্ধে ‘ওয়ারেন্ট’ বেরিয়েছে। তাদের খুঁজে বের করতে সব রকম চেষ্টাই করা হচ্ছে।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক পুলিশ কর্তার দাবি, ‘‘পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন আকাল ও সনৎ বাগদি নাবালক খুনের কথা মেনে নেয়। চুরি করার পরে সুরজিৎকে শিক্ষা দিতেই বিড়ির ছ্যাঁকা দেওয়া হয়, তা-ও মেনে নেন তাঁরা।’’ একই সঙ্গে তাঁর মত, তার জেরে যে সুরজিতের মৃত্যু হতে পারে তা ভাবতেও পারেননি তাঁরা। এ দিকে, পুলিশি তদন্তে উঠে আসে কার্তিকদের বাড়িতে থাকা নাইলনের জালের একাংশ দড়ির মতো করে কেটে সুরজিতের গলায় ফাঁস লাগানো হয়। জালের বাকি অংশও পরে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়। এরপরেই একে একে গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্তদের। ধরা যায়নি শুধু কার্তিক আর বিশুকে। খুনের ৮৬ দিনের মাথায় যাবতীয় প্রমাণ-সহ চার্জশিট জমা পড়ে। তারপর কলকাতা হাইকোর্ট ১৩৪ দিনের মাথায় অন্যতম অভিযুক্ত আকাল ও সনতের জামিন মঞ্জুর করে। কেন জামিন?

অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী রাফেউল হক বলেন, ‘‘ময়না-তদন্ত রিপোর্টে লেখা ছিল ‘অ্যান্টি মর্টেম ইন নেচার’। তা ছাড়া প্রধান দুই অভিযুক্ত ফেরার থাকায় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব শুরু করা যাবে না বলে বিচারক মত দেন। হয়তো সেই কারণেই জামিন মঞ্জুর হয়।’’ উচ্চ আদালত জামিন মঞ্জুর করার দিন দশেক পর বাপ্পা বাগদির জামিন মঞ্জুর করেন সিউড়ি জেলা আদালতের বিচারক সুপ্রতীম ভট্টাচার্য। জামিন যতই হোক না কেন, ক্ষোভ কমেনি এলাকায়। তারই প্রমাণ খুনীদের শাস্তি চেয়ে সুরজিতের সহপাঠীদের ফ্লেক্স। যাতে লেখা ‘অপরাধীদের ফাঁসি চাই’। তবে আকাল বাগদি, সনৎ কিংবা বাপ্পারা খুনের অভিযোগ মানতে চাননি। তিন জনেরই এক সুর, ‘‘আমরা যুক্ত নই। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’’

এ দিকে, এক মাত্র ছেলেকে নিয়ে একরাশ স্বপ্ন বুনেছিলেন পিরু বাগদি। দিনমজুরের কাজ করে ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু, একটি চুরির অভিযোগ, তার জেরে ছেলের অপমৃত্যুতে তছনছ হয়ে গিয়েছে সে সব। বাড়ির দাওয়ায় বসে কথা হচ্ছিল পিরুর সঙ্গে। তিনি বলেন চলেন, ‘‘কী ভেবেছিলাম আর কী হল। জীবনটাই পাল্টে গেল। ভাইকে হারিয়ে মেয়েটাও মনমরা থাকে। আর পুলিশ কী করছে— মূল অভিযুক্তকেই তো ধরতে পারল না!’’ গলা বুজে আসে তাঁর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE