আতঙ্কের গল্প শোনাচ্ছেন পার্বতীদেবী। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
আর পাঁচটা দিনের মতো স্কুলে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তাটাই ধরেছিলেন। স্কুলে পৌঁছনোর ঠিক একশো মিটার আগে সঙ্কীর্ণ রাস্তাটায় পৌঁছতেই পুরনো অভিজ্ঞতা বদলে গেল আতঙ্কে। গলির মধ্যে ওই শিক্ষিকার গলা থেকে সোনার হার ছিনতাই করে নিল মোটরবাইকে সওয়ার দুই ছিনতাইকারী। ‘চোর চোর’ বলে পিছু নেওয়ার একটা চেষ্টা করেছিলেন শিক্ষিকা। কিন্তু, আগ্নেয়াস্ত্র বের করে মাটিতে গুলি ছুড়ে ছিনতাইকারীরা বুঝিয়ে দিল— আর এক পা এগোলেই সমূহ বিপদ!
না, কোনও ফিল্মি দৃশ্য নয়। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ খোদ জেলা সদর সিউড়ির ব্যস্ত সময়ে ডাঙালপাড়ার ঘটনা। দুষ্কৃতীরা অবাধে যেখানে এমন কাণ্ড ঘটাল, তার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই রয়েছে মেয়েদের স্কুল কালীগতি নারী শিক্ষানিকেতেন। গত অগস্টেই শহরের প্রকাশ্য রাস্তায় স্কুটিতে সওয়ার এক তরুণীকে গুলি করে খুন করার ঘটনা এখনও তাজা সিউড়িবাসীর মনে। তার মধ্যেই কালীগতি নারী শিক্ষানিকেতেনের ইতিহাসের শিক্ষিকা পার্বতী ঘোষের সঙ্গে এ দিন যা ঘটল, তাতে হাড়হিম হয়ে গিয়েছে অনেকেরই। প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে। ক্ষোভ তৈরি হয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। শহরের মানুষের ক্ষোভ, যে হার গিয়েছে তা আবার তৈরি হতে পারে। কিন্তু গুলিটা যদি ওই মহিলার শরীর লক্ষ করে চালাত দুষ্কৃতীরা? দিনের আলোয় পরিচিত এলাকায় এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা অবশ্য কল্পনাতেও আনতে পারেননি পার্বতীদেবী। ঘটনার ঘণ্টা কয়েক পরেও আতঙ্ক কাটছে না ওই তাঁর। বলছেন, ‘‘ওই রাস্তা দিয়ে আর নয়। মেয়ে সুদীপ্তা আমার স্কুলেই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েও বারণ করে বলেছে, ওই রাস্তা দিয়ে আর যেও না মা।’’
পুলিশ ও আক্রান্ত শিক্ষিকার কাছ থেকে জানা গিয়েছে, ২০১৩ সালে রানিগঞ্জের একটি স্কুল থেকে সিউড়ির এই স্কুলে যোগ দেন পার্বতীদেবী। এখন থাকেন রবীন্দ্রপল্লিতে। স্কুলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই পায়ে হেঁটে ১০ মিনিটে স্কুলে আসার জন্য মূল রাস্তার পরিবর্তে পল্লির মধ্যে দিয়ে আসা রাস্তাটাই ব্যবহার করেন। সোমবার স্কুলের কাছাকাছি গলির মধ্যে ঢুকতেই একটি মোটরবাইকে দুই আরোহী উল্টো দিক থেকে আচমকা উদয় হয় শিক্ষিকার সামনে। পার্বতীদেবীর কথায়, ‘‘বাইক তো রোজই যাতায়াত করে। তাই খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। কাছে এসেই পলকে আমার গলা থেকে সোনার হারটা ছিনিয়ে নিল ওরা। ওদের কারও মুখ ঢাকা ছিল না। এতটাই বেপরোয়া। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে চোর চোর বলে চিৎকার জুড়লাম। ছুটলাম ছিনতাইকারীদের পিছনে।’’ তাঁর চিৎকার শুনে কাছে থাকা দুই তরুণও তখন ধাওয়া করেছে। কিন্তু সামান্য এগোতেই সাবধান করে দেয় দুষ্কৃতীরা। ‘‘একটা রিভলভার উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘আর এক পা এগোবেন না’। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম খেলনা পিস্তল। ভুল ভাঙল যখন দেখলাম মাটি লক্ষ করে ওরা গুলি চালাল। আতঙ্কে চমকে উঠলাম। বাতাসে বারুদের গন্ধ,’’—বলছেন পার্বতীদেবী। ধাতস্থ হতে না হতেই তত ক্ষণে চোখের বাইরে চলে গিয়েছে ওই ছিনতাইকারীরা।
এখন স্কুলে ছাত্রীদের ছুটি। শুধুমাত্র শিক্ষিকাদের উপস্থিত হতে হচ্ছে। সহকর্মীর এমন অভিজ্ঞতার কথা শুনে আতঙ্কিত অন্য শিক্ষিকারাও। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মালবিকা সাহা বলছেন, ‘‘সত্যিই আতঙ্কের। তবে, আমি আরও বেশি করে চিন্তা হচ্ছে ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ওদের সঙ্গেও এমন কিছু হতে পারে।’’ ওই গলি রাস্তা দিয়ে আসতে কি আপনি বার করবেন? প্রধান শিক্ষিকা বলছেন, ‘‘এটা কি করা যায়? ওটাও জনপদের মধ্যেই পড়ে। ওখানেও তো বাড়িঘর রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটা কেন হবে?’’ একই প্রশ্ন করছেন শহরবাসীও। তাঁদের কথায়, মোটরবাইকে চড়ে এসে টাকা, মোবাইল ছিনতাই সিউড়ি শহরে রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও ঘটনার কিনারাও হয় না। এ বার তো সরাসরি গুলি ছুটল। ‘‘সাধারণ মানুষের এখন নিরাপত্তা কোথায়? শহরের মধ্যে প্রকাশ্য দিবালোকে কেন এ ভাবে দাপিয়ে বেড়াবে চোর-গুন্ডার দল?’’—প্রশ্ন সিউড়ির এক প্রবীণ বাসিন্দার।
সিউড়ি থানার আইসি সমীর কোপ্তি শিক্ষিকার হার ছিনতাই ও গুলি চালানোর ঘটনার কথা কার্যত মেনে নিয়েছেন। তাঁর দাবি, পুলিশ সাধ্যমতো দুষ্কৃতীদের ধরার চেষ্টা করছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা, জড়িতেরা এলাকারই। না হলে শহরের গলিপথে এতটা সরগড় হতো না ওই দুষ্কৃতীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy