(অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য)
সাড়ে তিন মাস আগের ঘটনাটি নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বীরভূমকে। ধর্ষিত নাবালিকার দেহ পুলিশ যখন নিয়ে যাচ্ছে, তখন গ্রামের ধানখেত ধরে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পিছনে পিছনে ছুটে যাওয়ার ছবিটা আজও স্পষ্ট অনেকের স্মৃতিতে।
কিন্তু, কিছুতেই কিনারা হচ্ছিল না ঘটনার। ক্ষোভ বাড়ছিল এলাকায়। অবশেষে মোবাইলের গতিবিধি ট্র্যাক করে ওই নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্ত তারাপীঠের আলম শেখকে রাজস্থান থেকে ফাঁদ পেতে ধরল সিআইডি। কিন্তু, তাকে পাকড়াও করে এ রাজ্যে নিয়ে আসতে রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে তদন্তকারীদের। বাথরুম যাওয়ার নাম করে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেয় ধৃত যুবক। অভিযুক্তকে ধরতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন তদন্তকারী অফিসারেরাও। রেললাইন ধরে ধাওয়া করে যুবককে ধরেও ফেলেন তাঁরা। দু’পক্ষই কমবেশি জখম হয়ে ভর্তি হন স্থানীয় হাসপাতালে।
শেষমেশ মঙ্গলবার আলমকে সিউড়ির বিশেষ আদালতে হাজির করল সিআইডি। ঘটনার সাড়ে তিন মাস পরে রাজস্থানের অজমেঢ়ের বৈশালীনগর থানা এলাকা থেকে ওই যুবক ধরা পড়ে। সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘খুনের পাশাপাশি ওই যুবকের বিরুদ্ধে পক্সো আইনে শিশুদের যৌন নির্যাতনের মামলাও রুজু করা হয়েছে। তদন্তকারী অফিসার অমরেশ মণ্ডল ধৃত আলমের ১০ দিনের সিআইডি হেফাজতের আবেদন জানান। বিচারক মহানন্দ দাস ধৃত ওই যুবককে ৯ দিনের হেফাজতে পাঠিয়েছেন।’’ ধৃত ওই যুবককে নিয়ে গিয়ে খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চালাবে সিআইডি।
গত ২ জুন রাতে তারাপীঠ থানা এলাকার একটি গ্রামে নিজের বাড়ি থেকেই ঘুমন্ত অবস্থায় নিখোঁজ হয়ে যায় বছর দশেকের মেয়েটি। পরিজনেরা রাতভর তল্লাশি চালানোর পরে মেয়েটির নিথর দেহ মেলে বাড়ির অদূরে মাঠের ধারে একটি অস্থায়ী খড়ের ছাউনিতে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান ছিল, অন্যত্র ধর্ষণ করে খুন করে ওই ছাউনিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে নাবালিকার দেহটি। ওই ঘটনার পরে এলাকাবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁদের বাধায় দীর্ঘক্ষণ দেহ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার দু’দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তদন্তভার নেয় সিআইডি। তারা একাধিক বার গ্রামে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। জিজ্ঞাসাবাদ করে নিহতের পরিবারের সদস্যদেরও। পরে গ্রামে তদন্তে গিয়ে নিহতের জেঠুর ঘরের উঠোনে রক্তের দাগ খুঁজে পায় ফরেন্সিক দল। ওই রক্তের দাগ নিহত নাবালিকারই কিনা, তা জানতে নমুনা পাঠানো হয় ফরেন্সিক ল্যাবে। তার রিপোর্ট এখনও আসেনি।
ঘটনাকে ঘিরে জেলার রাজনীতিও উত্তপ্ত হয়েছিল। ঘটনার পরপরই বাম ও কংগ্রেস এবং পরে বিজেপি-র পক্ষ থেকে ওই ঘটনায় থানা ঘেরাও-সহ নানা কর্মসূচিও নেওয়া হয়। ক্ষোভের পারদ চড়ছিল এলাকাতেও। এক মাসেও কিনারা না হওয়ায় থানা ঘেরাও করেন সিআইডি-র প্রতি আস্থা না রাখতে পেরে ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি জানান নিহতের মা। ঘটনার সময় দু’জন সন্দেহভাজনকে ধরলেও পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই সময় গ্রামের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে সূত্র হাতড়াতে শুরু করে সিআইডি।
ঘটনার পর দিন থেকেই গ্রামের যুবক আলম শেখকে এলাকায় দেখা যাচ্ছিল না। তাই ওই যুবকের জড়িয়ে থাকা নিয়ে তদন্তকারীদের সামনে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন নিহতের পরিজন এবং অনেক গ্রামবাসী। ওই যুবকের উপরে নজরদারি শুরু করে সিআইডি। রণজিৎবাবু এ দিন জানান, পেশায় রাজমিস্ত্রি আলম কাজের সুবাদে প্রায় দিনই গ্রামের বাইরে থাকত। তবে ২ জুন দুপুর থেকে ওই যুবককে মদ্যপ অবস্থায় গ্রামে ঘুরতে দেখেছিলেন এলাকার মানুষ। রণজিৎবাবুর দাবি, ‘‘সিআইডি-র জেরায় ধৃত স্বীকার করেছে, পড়শির ওই মেয়ের উপরে ওর বহু দিন ধরে নজর ছিল। ঘটনার রাতে সে মেয়েটিকে বাড়ি থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। প্রমাণলোপের জন্য তাকে খুন করে মাঠের দিকে খড়ের ওই ছাউনির মধ্যে দেহ ফেলে দেয়। ওই রাতেই গা ঢাকা দেয় আলম।’’ যদিও সিআইডির অনুমান, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আলমের সঙ্গে আরও কয়েক জন জড়িত। ধৃতকে জেরা করে তাদের নাম জানার চেষ্টা চালাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
সিআইডি সূত্রের খবর, দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ট্র্যাক করার পরে বৈশালীনগরের একটি জায়গায় আলমের গতিবিধির কথা জানা যায়। সেই মতো রাজ্য থেকে তিন সদস্যের সিআইডি-র একটি দল রাজস্থানে যায়। ১৬ সেপ্টেম্বর বৈশালীনগর থেকেই পাকড়াও করা হয় আলমকে। তিন দিনের ট্রানজিট রিমান্ড মেলে। পর দিন ট্রেনে আলমকে নিয়ে রাজ্যের পথে ফিরছিলেন তদন্তকারীরা। কানপুর স্টেশনের আগে বাথরুম যেতে চায় আলম। রণজিৎবাবুর কথায়, ‘‘বাথরুম সেরে আসার পথে এক অফিসারকে ধাক্কা মেরে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে ওই যুবক। ওকে ধরতে অফিসারেরাও ঝাঁপ দেন। ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলা হয়।’’ লখনউয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসার পরে এ দিন আলমকে নিয়ে রাজ্যে ফেরে সিআইডির দলটি।
মেয়ে আর ফিরবে না। কিন্তু আলম ধরা পড়ায় খুশি ফিরেছে তারাপীঠের ওই গ্রামে। সিআইডি-র অফিসারদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নিহতের মা-বাবা। কান্না ভেজা গলায় দু’জনেই বলেন, ‘‘জলজ্যান্ত মেয়েটা বাড়িতে ঠাকুমার পাশে ঘুমোল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে খুন করা হল। আমার মেয়ের সঙ্গে যারা এই নৃশংস কাজ করল, তাদের চরম সাজা চাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy