সব্জি বাজারে এ ভাবেই বছরের পর বছর জমা হয় জঞ্জাল।
জাতীয় সড়কের ধার। শহরের একটি নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হেঁটে ফিরছিলেন মাড়গ্রাম থানার বুধিগ্রাম এলাকার বাসিন্দা বছর পঞ্চান্নর এক মহিলা। ফিরতে ফিরতেই নাকে হাত দিয়ে সঙ্গী নাতনিকে বলছিলেন, “এ শহরে মানুষ থাকে! কি করে যে তোরা বেঁচে থাকবি। গোটা শহরটাই আস্তাকুড়।”
এ ক্ষোভ কেবলমাত্র ওই মহিলার নয়, রোজকার রামপুরহাট শহরের বাসিন্দাদের। জাতীয় সড়কের ধারের দুর্গন্ধ নিয়ে পথ চলতি মানুষের ক্ষোভের কথা শুনে এলাকার বাসিন্দা চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় যেমন বললেন, “কি অবস্থা বলুন তো, সত্যিই এই পরিবেশে মানুষের বাস করা যায়।” আর এক বাসিন্দা পার্থ সারথী রায় বললেন, “দুর্গন্ধের চোটে জাতীয় সড়কের ডান দিক দিয়ে হাঁটাই বন্ধ করে দিয়েছি।”
যে এলাকা নিয়ে এত কথা, সেটা রামপুরহাট শহরের অতি পরিচিত একটি এলাকা। জায়গায় জায়গায় জমা হয়ে আছে পচা সব্জি, এঁটো শালপাতা, থার্মোকলের পাতা, খড়, প্লাষ্টিকের প্যাকেটের সঙ্গে নিকাশি নালার কাদা মেশানো ময়লা। অথচ, এলাকায় রয়েছে শ্রম দফতরের রামপুরহাট মহকুমা সহ-কমিশনার অফিস। একই চত্ত্বরে আছে মহকুমার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ অফিস, রেশম দফতরের অফিস। জাতীয় সড়কের আর এক পাশে রয়েছে এগ্রি মেক দফতর। ঘটনা হল, ভাঁড়শালা মোড় থেকে হাঁটা পথে ২০০ মিটারের মধ্যে এই সমস্ত অফিসগুলো পড়ে। যাওয়ার আগে রাজ্য বিদ্যুত বন্টন কোম্পানির রামপুরহাট বিভাগীয় অফিস এবং একটি নার্সিংহোম পেরোতে হবে। কিন্তু পথচারী থেকে অফিসের কর্মী বা কাজের জন্য ওই সমস্ত অফিস গুলিতে দূর দূরান্ত এলাকা থেকে যাঁরা আসেন তাঁদেরকে রাস্তার ধার ধরে প্রায় ১০০ মিটার অংশ পার হতে হয়। আর ওই পথটুকু পার হতে গিয়েই জঞ্জালের গন্ধে সবাই তিতিবিরিক্ত।
রামপুরহাট ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, আতিউর রহমানরা জানালেন, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা জঞ্জালের জন্য এলাকার বাসিন্দারা বাড়ির জানালা খুলে রাখতে পারে না। পথচারীরা রাস্তার পাশ দিয়ে চলার সময় নাকে রুমাল চাপা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এলাকা পেরিয়ে যান। এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষোভ, এলাকার দুর্গন্ধময় পরিবেশ দেখে মনে হয় না একটা পুরসভা আছে।
জাতীয় সড়কের ধারে লোটাস প্রেস মোড় পেরিয়ে বট তলার সামনের অংশ, সেখানেও একই ভাবে জঞ্জাল ফেলার গন্ধে এলাকায় বাস করা দায় হয়ে পড়েছে বাসিন্দাদের। স্থানীয়রা জানান, এসডিও উদ্যোগ নেওয়ার পর জাতীয় সড়কের ধারে জঞ্জাল ফেলা কিছুদিন বন্ধ হয়েছিল। তারপর ফের সেই একই অবস্থা। এখন রামপুরহাট শহর ঢুকতে সানঘাটাকাঁদর পেরিয়ে রাস্তার দু’ধারে জঞ্জাল না ফেলা হলেও লোটাস প্রেসের মোড় এলাকা আর এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ অফিস সংলগ্ন এলাকায় রাস্তার দু’ধারে জঞ্জাল ফেলা বন্ধ হল না।
শহরজুড়ে জঞ্জাল পড়ে থাকা নিয়ে ক্ষোভ জানাতে গিয়ে বাসিন্দারা জানান, পুরসভা এতদিনেও জঞ্জাল সাফাই নিয়ে একটা স্থায়ী জায়গা আজও গড়ে তুলতে পারল না। পাঁচ মাথা মোড় থেকে ব্যাঙ্ক রোড যাওয়ার রাস্তার উপর রামপুরহাট মহকুমাশাসকের কার্যালয় অফিস সংলগ্ন এলাকা, জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবন স্কুলের প্রাচীরের গায়ে আজও পুরসভার জঞ্জাল ফেলা হয়। রামপুরহাট হাটতলা এলাকায় স্তপীকৃত জঞ্জাল দিনের পর দিন উচ্চতায় ছোট খাটো টিলার আকার নিয়েছে। আবার পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের তালবোনা পুকুরের পাড় এলাকা, লোটাস প্রেস মোড়ের পুকুর পাড় এলাকা-সহ প্রায় সর্বত্র জঞ্জাল সাফাই নিয়ে ক্ষোভ।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরসভা এলাকায় স্যানিটেশন প্রকল্পে ১৩ জন মহিলা এবং ১৪ জন পুরুষ সব মিলিয়ে ২৭ জন স্থায়ী চতুর্থ শ্রেণি কর্মী পদে নিযুক্ত আছেন। এই সংখ্যাটা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ৩৩ জন ছিল। তাঁদের মধ্যে মহিলারা রাস্তায় ঝাড়ু দেয়। পুরুষরা নিকাশি নালার ময়লা তোলে, জলের ট্যাঙ্কি পরিস্কার করে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করে।
পুরসভায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ি ১০০০ জন পিছু ৩ জন করে মোট ১৮০ জন ঝাড়ুদার থেকে ওয়ার্ড পরিস্কার রাখার কর্মী দরকার। পুরসভা এলাকায় স্থায়ী ঝাড়ুদার হিসাবে অস্থায়ী ১০০ জন কর্মী কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে পুরুষ কর্মীদের জন্য ১৬০ টাকা করে দৈনিক মজুরি দেওয়া হয়। মহিলা অস্থায়ী শ্রমিকদের দৈনিক ৬০ টাকা করে মাসে ১৮০০ টাকা দেওয়া হয়। আবার সাফাই এর কাজে নিযুক্ত তিনটি ট্রাকটর চালককে ১৭৫ টাকা করে দৈনিক মজুরি দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে একটি ট্রাকটর পাঁচ মাথা মোড় সংলগ্ন মহকুমাশাসকের প্রশাসনিক ভবনের সামনে জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবন স্কুলের দেওয়াল লাগোয়া এলাকার প্রতিদিনের জমে থাকা ময়লা ফেলার কাজে ব্যবহার করা হয়। বাকি দুটি ট্রাকটর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জমে থাকা ময়লা তুলে ফেলার জন্য ব্যবহার করা হয়। পাঁচ মাথার ট্রাকটরের জন্য পাঁচ লিটার করে জ্বালানি তেল খরচ হয় প্রতিদিন। আর ওয়ার্ডে ব্যবহৃত ট্রাকটর গুলির জন্য ৬ লিটার করে জ্বালানী তেলের খরচ দেওয়া হয়। এছাড়া ওয়ার্ড পরিস্কার রাখার জন্য কাঊন্সিলরদের প্রতি মাসে ৫০০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন উঠছে, পুরসভা এলাকার জঞ্জাল সাফাইয়ের জন্য এত টাকা খরচ করার পরও এলাকায় এলাকায় জমে থাকা জঞ্জালে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, নিকাশি নালা পরিস্কার করার জন্য রামপুরহাট পুরসভায় সাংসদ শতাব্দী রায়ের সাংসদ এলাকা উন্নয়ন খাতে দেওয়া ঝাঁট দেওয়া যন্ত্র, নিকাশি নালা পরিস্কার করার যন্ত্রগুলি পুরসভা কোনও কাজে লাগছে না। পুরসভা সম্প্রতি যে একটি ছোট ট্রাকটর কিনেছে সেটিও বর্তমানে কাজে লাগছে না। বিভিন্ন ওয়ার্ডে সিমেন্টের ভ্যাট থেকে জমে থাকা ময়লা মাসের মধ্যে একবারও পরিস্কার হয় না।
আবর্জনায় ঢেকেছে জাতীয় সড়কের একাংশ। দুর্গন্ধে চলা দায় পথচারীর। —নিজস্ব চিত্র।
ঘটনা হল, মহকুমাশাসক উমাশঙ্কর এস শহরে প্লাষ্টিক দূষণ নিয়ে ব্যবস্থা নিলেও, এখনও নিকাশি নালাগুলি পরিস্কারের ক্ষেত্রে তদারকির অভাবে নিয়মিত পরিস্কার হয় না। আবার ময়লা তুলে ফেলার পর সেগুলি গাড়িতে করে তুলে ফেলতে দেরি হওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ড্রেনের ময়লা কিছু দিন পরে ড্রেনেই চলে যায়।
এরইমধ্যে পুরভোটের দিন ঘোষণা করার আগে পুরসভা বিভিন্ন ওয়ার্ডে জঞ্জাল ফেলার জন্য প্লাষ্টিকের ১০০টি ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু জমা জঞ্জাল পরিস্কার না করেই ডাস্টবিন বসানোর জন্য এখনও পর্যন্ত সেই জমা জঞ্জালেই এলাকার বাসিন্দারা জঞ্জাল ফেলছে। জঞ্জালের পাহাড় জমেছে হাটতলাতেও। এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর বিজেপি-র শুভাশিষ চৌধুরী বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে জমা জঞ্জাল সরানোর জন্য পুরসভায় জানিয়ে আসছি। কিন্তু পুরপ্রধানের সদিচ্ছার অভাবে সেই জমা জঞ্জাল থেকে গিয়েছে।”
পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারি বলেন, “হাটের জঞ্জাল সাফাই এর জন্য সম্প্রতি ৪ লক্ষ টাকা দর পত্র আহবান করা হয়েছে। জঞ্জাল সাফাই করে পুরসভা সেখানে শৌচালয় নির্মাণ করবে।” অন্যদিকে পুরসভার বর্তমান স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে রামপুরহাট পুরসভার স্যানিটারি ইন্সপেকটর সুশেন মণ্ডল বলেন, “যে পরিকাঠামো আছে তাতে যথেষ্ট পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে পরিকাঠামো গত আরও উন্নতির দরকার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy