নথির অভাবে মুক্তি!
কারও বিরুদ্ধে রয়েছে খুনের অভিযোগ। কারও বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা। এমন সব গুরুতর ঘটনায় অভিযুক্তদের ছেড়ে দিয়েছে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড। ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে চুরি, ছিনতাই, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের মতো আরও নানা ঘটনায় অভিযুক্তেরাও। আদালত যাঁদের ছেড়েছে, তাঁরা কেউ-ই কিন্তু বেকসুর খালাস হননি। মামলা সংক্রান্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ সব নথিপত্র খুঁজে না পাওয়াতেই জাস্টিস বোর্ড অভিযুক্তদের ছেড়ে দিতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছে।
আর তার পরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কোন পক্ষের গাফিলতিতে মামলার নথি হারিয়ে অভিযুক্তেরা বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হতেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে যদিও পুলিশের ভূমিকাকেই দুষছেন জাস্টিস বোর্ডের সদস্যদের অনেকেই।
প্রশাসন সূত্রের খবর, ১৯৮৬ সালে গঠিত ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট’কে পুনর্গঠিত করে ২০০০ সালে তৈরি হয় ‘জুভেনাইল জাস্টিস কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অফ চিল্ড্রেন অ্যাক্ট’। ২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত এই ধরনের সমস্ত মামলার বিচার চলত কলকাতায়। তাতে মামলার পাহাড় জমে বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায় অভিযুক্ত নাবালকদের বিচার প্রক্রিয়া প্রায় থমকে থাকত। ওই বছরই আগের আইন সংশোধিত হওয়ার পরে বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে জেলায় জেলায় জাস্টিস বোর্ড তৈরি হয়। সেখানে শিশু ও নাবালক অপরাধীদের (দোষী সাব্যস্ত হলে) স্বল্প সাজা (খুনের অপরাধী হলেও সর্বোচ্চ তিন বছর হোমে থাকা) দেওয়া হয়। কাউন্সেলিং দেওয়ার পরে ওই নাবালকদের যাতে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসে, সেটাই আসল লক্ষ্য। বীরভূমের সিউড়িতে থাকা জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড সম্প্রতি কয়েকটি মামলায় অভিযুক্তদের খালাস করে দেওয়ায় শুরু হয়েছে বিতর্ক।
ঠিক কী ঘটেছে?
জাস্টিস বোর্ড সূত্রের খবর, একটি মামলায় চার্জ গঠন বা বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য যে সব নথিপত্র ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যেমন আসল বা সার্টিফায়েড এফআইআর কপি, ইনজুরি রিপোর্ট, সিজার লিস্ট, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট ওই মামলাগুলির ক্ষেত্রে কোনও কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি! বছরের পর বছর মামলার অভিযুক্তেরা শুধু আদালত আর ঘরে ছোটাছুটি করেছেন। কিন্তু, বর্তমানে সংশোধিত আইন অনুযায়ী নাবালক অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ৬ মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। তা ছাড়া, এত দিন ধরে যথেষ্ট ধকল নিতে হয়েছে আদালত আর বাড়ি যাতায়াতে। দ্বিতীয়ত, মামলায় অভিযুক্তেরা এক দিনের জন্যও শুনানিতে অনুপস্থিত হননি। ফলে নথিপত্র না মিললেও অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না জাস্টিস বোর্ডের।
এ রকম দু’টি মামলার কথা জানা গিয়েছে। ১৯৮৭ সালের ১৯ নভেম্বর বোলপুরে একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিল বছর সতেরোর এক কিশোর। তার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার ধারা দিয়ে মামলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু অভিযুক্ত নাবালক হওয়ায় তার মামলাটি কলকাতার সল্টলেকে জুভেনাইল আদালতে স্থানান্তরিত হয়। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য ২০০৯ সালে জেলায় জেলায় ‘জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড’ গঠিত হয়। তখন মামলাটিও সংশ্লিষ্ট জেলায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। কিন্তু, দীর্ঘ দু’দশকেও সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। গত জানুয়ারিতেই খালাস পেয়ে যান সে দিনের কিশোর, বর্তমানে মধ্য চল্লিশের ওই অভিযুক্ত। তবে, বেকসুর খালাস পেয়েছেন তিনি, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, মামলা চালানোর জন্য উপযুক্ত নথিপত্র জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের হাতে ছিল না। ফলে অভিযুক্তের আইনজীবীর আবেদনের ভিত্তিতে বিচার অসম্পূর্ণ রেখেই তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় জাস্টিস বোর্ড। একই ভাবে গত জানুয়ারিতেই মুক্তি পেয়েছেন খুনের একটি মামলায় অভিযুক্ত দুই কিশোর (বর্তমানে যুবক)। ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে মুরারইয়ে একটি খুনের মামলায় নাম জড়িয়েছিল একই পরিবারের বছর বারো ও তেরোর ওই দুই কিশোরের।
ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন জেলা জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সদস্যদের একাংশ। এক সদস্যের দাবি, “শুধু ওই দু’টি মামলাই নয়, কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসা আরও অন্তত পাঁচটি মামলার ক্ষেত্রেও অদূর ভবিষ্যতে একই পরিণতি অপেক্ষা করছে!” ওই সদস্যেরা জানান, বহু বার সংশ্লিষ্ট সমস্ত জায়গায় নথি পাঠানোর আবেদন জানিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকী, নথি চেয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে বোলপুর ও রামপুরহাট কোর্টের জিআরও, সংশ্লিষ্ট থানা, ঘটনার তদন্তকারী অফিসার এবং সল্টলেকের জুভেনাইল আদালতের সঙ্গেও। কিন্তু, কোনও ফল মেলেনি। এ তো গেল কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসা মামলা। জেলায় জাস্টিস বোর্ড গঠিত হওয়ার পরেও বিভিন্ন থানা এলাকায় অপরাধমূলক ঘটনায় নাবালকদের অভিযুক্ত থাকার মামলার ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যাচ্ছে বলে দাবি। দু’ক্ষেত্রেই নথি না মেলার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকাকে দুষছে বোর্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সরকারি আইনজীবী কৃষ্ণেন্দু গোস্বামী বলছেন, “এমনও হয়েছে, একটি ঘটনার বিচারপর্ব শেষ। কিন্তু, সেখানে নাবালক অভিযুক্তের বিচার সম্পন্ন হয়নি। এতে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের উদ্যেশ্যই বিপন্ন হচ্ছে।” অভিযোগ সম্বন্ধে সরাসরি কিছু বলতে চাননি জেলার বর্তমান পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার। এ নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “পুরো বিষয়টি ভাল করে না জেনে কিছু মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আর এটা শুধু পুলিশের উপর নির্ভর করে না। অন্য দফতরও রয়েছে। ভাল করে খোঁজ নিতে হবে, সমস্যা কোথায়।”