Advertisement
০২ মে ২০২৪
পুরসভার প্রতিষ্ঠার সময় নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন

খোঁড়াচ্ছে উন্নয়ন, উৎসবের খরচ নিয়ে বিতর্ক

পুরসভার বয়স কত? তা নিয়েই রয়েছে ধোঁয়াশা। এর মধ্যেই বাঁকুড়া পুরসভার সার্ধশতবর্ষ পালন করা নিয়ে পুর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে নতুন করে জন্ম নিয়েছে বিতর্ক। শুধু পুরসভার বয়স নিয়েই নয়, উৎসব পালনের খরচের বহর নিয়েও বিতর্কের জল গড়াতে শুরু করেছে। বিরোধীরা এই উৎসব পালনের মধ্যে আগামী বছর পুরভোটে শাসক দলের ফায়দা তোলার গন্ধও পাচ্ছেন। আর এ সব নিয়েই বাঁকুড়া এখন সরগরম। এত দিন বাঁকুড়া পুরভবনের দেওয়ালে বড়বড় অক্ষরে লেখা ছিল পুরসভা স্থাপিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে। সম্প্রতি শেষের ৯ সংখ্যাটি উধাও হয়ে গিয়েছে। তারপরেই আগামী জুলাই মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পুর কর্তৃপক্ষ সার্ধশতবর্ষ পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় জলঘোলা শুরু হয়েছে।

বাঁকুড়া পুরসভার দেওয়ালে এতদিন প্রতিষ্ঠার সময়কাল লেখা ছিল ১৮৬৯। কিন্তু সম্প্রতি ৯ সংখ্যাটি পুর কর্তৃপক্ষ সরিয়ে দিয়ে দাবি করছে ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে পুরসভা। সেই হিসেব ধরে শুরু হতে যাচ্ছে সার্ধশতবর্ষ উৎসব। এ নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। ছবি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

বাঁকুড়া পুরসভার দেওয়ালে এতদিন প্রতিষ্ঠার সময়কাল লেখা ছিল ১৮৬৯। কিন্তু সম্প্রতি ৯ সংখ্যাটি পুর কর্তৃপক্ষ সরিয়ে দিয়ে দাবি করছে ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে পুরসভা। সেই হিসেব ধরে শুরু হতে যাচ্ছে সার্ধশতবর্ষ উৎসব। এ নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। ছবি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৪ ০১:০৫
Share: Save:

পুরসভার বয়স কত? তা নিয়েই রয়েছে ধোঁয়াশা। এর মধ্যেই বাঁকুড়া পুরসভার সার্ধশতবর্ষ পালন করা নিয়ে পুর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে নতুন করে জন্ম নিয়েছে বিতর্ক। শুধু পুরসভার বয়স নিয়েই নয়, উৎসব পালনের খরচের বহর নিয়েও বিতর্কের জল গড়াতে শুরু করেছে। বিরোধীরা এই উৎসব পালনের মধ্যে আগামী বছর পুরভোটে শাসক দলের ফায়দা তোলার গন্ধও পাচ্ছেন। আর এ সব নিয়েই বাঁকুড়া এখন সরগরম।

এত দিন বাঁকুড়া পুরভবনের দেওয়ালে বড়বড় অক্ষরে লেখা ছিল পুরসভা স্থাপিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে। সম্প্রতি শেষের ৯ সংখ্যাটি উধাও হয়ে গিয়েছে। তারপরেই আগামী জুলাই মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পুর কর্তৃপক্ষ সার্ধশতবর্ষ পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় জলঘোলা শুরু হয়েছে। ওই ন’মাস ধরে একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়েছে পুরসভা। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। পুরপ্রধান শম্পা দরিপা যেখানে পুরপরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কথায় কথায় টাকা নেই বলে দাবি করেন, সেখানে অত টাকা শুধু উৎসবের পিছনেই কেন ব্যয় করা হবে, তা নিয়ে কাউন্সিলর থেকে পুরবাসীর মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে শোভাযাত্রার মাধ্যমে সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপন কর্মসূচি শুরু করছে বাঁকুড়া পুরসভা। জুলাই থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ফুটবল প্রতিযোগিতা, প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতা, গুণিজন সংবর্ধনা, মিলন মেলার মতো খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বহু কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুরভবন নতুন করে রঙ করা-সহ ভবনের সামগ্রিক পরিকাঠামো উন্নয়নের কথা ভাবা হয়েছে। পুরো কাজ দেখাশোনা করার জন্য গড়া হয়েছে ১৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন কমিটি। পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রেখা দাস রজককে কমিটির সম্পাদক করা হয়েছে। গত ৫ জুন এই কমিটি বৈঠক ডেকে সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনের বাজেট পেশ করেছে। রেখাদেবী বলেন, “প্রায় ২০ লক্ষ টাকার বাজেট ধরা হয়েছে। রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করে ১০ লক্ষ টাকা চেয়েছি। বাকি টাকা কী ভাবে জোগাড় করা হবে তা নিয়ে আমরা আলোচনা চালাচ্ছি।”

খরচের এই বহর নিয়েই ফুঁসতে শুরু করেছেন বিরোধীরা। পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা জেলা কংগ্রেস সভানেত্রী রাধারানি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “ওয়ার্ডে উন্নয়নের কাজ থমকে। পুরপ্রধানকে বলতে গেলেই টাকা নেই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। অথচ লক্ষ লক্ষ টাকা উৎসবে ব্যয় করতে যাচ্ছেন তিনি। এতে শহরের পরিকাঠামোর কী উন্নয়ণ হচ্ছে?” ১ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল কাউন্সিলর সঞ্চিতা লাহা-ও অভিযোগ তুলেছেন, “আমার ওয়ার্ডে বহু বাসিন্দার বাড়িতে শৌচালয় নেই। তাঁদের বাইরে প্রাকৃতিক কাজ সারতে হয়। অথচ প্রায় এক বছর আগে পুরপ্রধানের কাছে এলাকায় একটি শৌচালয় তৈরি করে দেওয়ার আবেদন জানানোর পরেও সেই কাজ এখনও হয়নি।” তাঁর আক্ষেপ, পুরসভার ১৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের বরাদ্দ টাকার কিছুটা শহরের পরিকাঠামোর উন্নয়নের কাজে লাগালে অনেক উপকার হত।

বাসিন্দাদের মধ্যেও এ নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের পুরাতন রথতলা এলাকায় পুরসভার নজরুল উদ্যান দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে রয়েছে। বাসিন্দাদের একাংশের ফেলা আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে পার্কের পরিবেশ। স্থানীয় বাসিন্দা অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম গোস্বামীরা জানান, পুরসভাকে এ বিষয়ে জানানো হলেও কোনও কাজ হয়নি। তাঁদের মতে, “উৎসব হোক। কিন্তু তার পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ না করে সেই টাকায় বরং কিছু গঠনমূলক কাজ হলে বাসিন্দাদের কাছে তা আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।” একই রকম ক্ষোভ রয়েছে শহরের রাস্তা থেকে নিকাশী নিয়েও।

বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডের দুরাবস্থা নিয়েও যাত্রীদের ক্ষোভ কম নয়। সম্প্রতি বাঁকুড়া পুরসভা বাসস্ট্যান্ডের একাংশে ঢালাই করে আলোক স্তম্ভ বসিয়েছে। তাতেও কমেনি ক্ষোভ। আঁচুড়ির বাসিন্দা পেশায় গাড়ি চালক বাপি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আলোর তো প্রয়োজন ছিলই, কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে পরিচ্ছন্ন শৌচালয়ের প্রয়োজনীয়তাও কম নয়। সাফাইয়ের অভাবে শৌচালয়টি নরক হয়ে উঠেছে। পানীয় জলেরও সুবন্দোবস্ত নেই। পুর কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে ভাবলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ভাল হত।”

রাজ্য রাজনীতিতে নতুন করে বলীয়ান হয়ে ওঠা বিজেপিও এই ইস্যুকে সামনে নিয়ে তৃণমূল পরিচালিত এই পুরসভার কাজের বিরোধিতা করতে আসরে নামতে চলেছে। বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার বলেন, “রাজ্যের তৃণমূল সরকার স্বজনপোষণ ও মোচ্ছব করতে কোটি কোটি টাকা উড়িয়ে যাচ্ছে। বাঁকুড়া পুরসভাও তেমনই করতে যাচ্ছে। শহরের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে শহরবাসীকে নতুন কিছু উপহার দিয়েও সেই আনন্দ উদ্যাপন করা যেতে পারত।”

পুরপ্রধান শম্পা দরিপা অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “উৎসব পালন সামাজিক কাজ। তা উন্নয়নের প্রতীক বলেই আমরা মনে করি।” তাঁর দাবি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শকে সামনে রেখে তাঁর অনুমতি নিয়েই এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। শম্পাদেবীর মতে, “সামাজিক মেলবন্ধন না ঘটলে কোনও দিন উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়নের গতি থমকে দিতে পিছনে কথা বলার জন্য বহু মানুষ আছেন। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই তাঁরা এ সব কথা বলছেন।”

কিন্তু পুরসভার বয়েস নিয়েই যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। উৎসবের আগে পুরভবনের দেওয়াল থেকে কেন পুরসভা স্থাপনের সময় সরিয়ে নেওয়া হল? পুরপ্রধানের দাবি, “এতদিন পুরভবনের গায়ে ভুল তথ্য লেখা ছিল। তাই ৯ সংখ্যাটি আমরা তুলে দিয়েছি। বাঁকুড়া পুরসভা ১৮৬৫ সালেই গঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে আমার কাছে প্রকৃত নথিপত্র রয়েছে। কারও সংশয় থাকলে এসে দেখে যেতে পারেন।” অন্য দিকে বিজেপি নেতা সুভাষবাবুর দাবি, পুরসভা স্থাপিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে। আগামী বছর পুরভোটের স্বার্থে তৃণমূলের বোর্ড এখন প্রকৃত তথ্যটিকেও বিকৃত করছে। আমার কাছে প্রমান রয়েছে ১৮৬৯ সালেই এই পুরসভা স্থাপিত হয়েছিল।

নেতা-নেত্রীদের এই তরজা চলবেই। সময় যত এগোবে, সুর চড়বে নেতায়-নেতায়। বছর ঘুরলেই যে ভোট!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE