Advertisement
১৮ মে ২০২৪
দলের সদস্য বাড়ল কি, খোঁজ নিয়েই দায় সারলেন দুধকুমার

চোখা প্রশ্নে কর্মীদের ক্লাস নিলেন অনুব্রত

যতটা গর্জন, ততটা বর্ষণ হবে তো? পুরভোটের মুখে রামপুরহাটে বিজেপি-র সাংগঠনিক বৈঠক শেষে এমনটাই প্রশ্ন তুলছেন দলের কর্মীরা। অন্তত যে বীরভূম জেলাকে শীর্ষ নেতৃত্ব আন্দোলনের মুখ হিসেবে দেখাতে চাইছেন, সেখানে প্রতিপক্ষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংগঠনকে সাজানোর কাজ এখনও ঢের বাকি বলেই তাঁদের মত।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০১:২৪
Share: Save:

যতটা গর্জন, ততটা বর্ষণ হবে তো?

পুরভোটের মুখে রামপুরহাটে বিজেপি-র সাংগঠনিক বৈঠক শেষে এমনটাই প্রশ্ন তুলছেন দলের কর্মীরা। অন্তত যে বীরভূম জেলাকে শীর্ষ নেতৃত্ব আন্দোলনের মুখ হিসেবে দেখাতে চাইছেন, সেখানে প্রতিপক্ষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংগঠনকে সাজানোর কাজ এখনও ঢের বাকি বলেই তাঁদের মত। রামপুরহাটে দুই শিবিরের সাম্প্রতিক কর্মিসভার তুল্যমূল্য বিচারেও সেই প্রশ্নই সামনে এসেছে।

দৃশ্য ১: জেলা সভাপতি প্রশ্ন করছিলেন, বুথ পিছু মোট ভোটার, মহিলা ভোটার, এমনকী সংখ্যালঘু-তফশিলি জাতি-তফশিলি জনজাতি কত? পটাপট সমস্ত হিসেবই দিয়ে গেলেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তৃণমূলের শিবির।

দৃশ্য ২: এলাকায় কেবল দলীয় সদস্য সংখ্যার হিসেব দিয়েই খালাস পেলেন অঞ্চল সভাপতিরা। তার বেশি কিছু জানতেও চাইলেন না দলের জেলা সভাপতিও। বিজেপির শিবির।

গত শনিবার ও রবিবার রামপুরহাট ১ ও ২ ব্লকে হয়ে যাওয়া দুই দলের দু’টি কর্মিসভার খণ্ডচিত্র, এলাকায় দু’দলের সাংগঠনিক শক্তি আর দুর্বলতার ফারাকটা অনেকটাই প্রকট করে দিল। দু’দলের কর্মীরা স্বীকার করেছেন, শুধু কর্মী সংখ্যার দিক থেকেই নয়, সাংগঠনিক বোধবুদ্ধি থেকে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজেপি-কে টেক্কা দিয়ে গেল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। শনিবার জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সামনে এলাকার সাংগঠনিক হাল হকিকত হাতের তালুর মতোই তুলে ধরলেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। কিন্তু, তেমনটা দেখা গেল না রবিবার বিজেপি-র কর্মিসভায়। সেখানে এলাকায় সদস্য সংখ্যা কেন বাড়ছে না, নেতাদের তা নিয়ে জবাবদিহিও করতে হল না জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের সামনে।

দরজায় কড়া নাড়ছে পুরভোট। আগামী বছরই বিধানসভা ভোট। একদিকে তৃণমূল যাবতীয় ঝড়-ঝাপটা সামলে রাজ্যে নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্য দিকে, মোদীর নাম অবলম্বন করে রাজ্যে যুযুধান হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। সামনে তাদের ‘মিশন ১৪৯’-এর লক্ষ্য। ওই সংখ্যক আসন পেলেই তারা রাজ্য দখল করবে। গত কয়েক মাসে রাজ্যের যে ক’টি জায়গায় দুই দলের কর্মীদের মধ্যে সংঘাত দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে সব থেকে বেশি রক্ত ঝরেছে এই জেলারই পাড়ুইয়ে। এখানে তৃণমূলের সমর্থকদের একটা বড় অংশ বিজেপিতে সরে এসেছে। তাই বিজেপির বড় ভরসা এই জেলা।

শনিবার হাঁসন বিধানসভা কেন্দ্রের রামপুরহাট ২ ব্লকের বুথ কর্মীদের নিয়ে তারাপীঠের একটি লজের কনফারেন্স রুমে সভা করেন তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব। রবিবার নারায়ণপুরে বিজেপি রামপুরহাট বিধানসভার অন্তর্গত রামপুরহাট ১ ব্লকের কর্মীদের নিয়ে সম্মেলন করল। তৃণমূলের কর্মিসভা ছিল আদতে অনুব্রতর ক্লাস। বিরোধী দল নিয়ে একটিও কথা বলেননি। এক বারের জন্যও মেজাজ হারাতে দেখা যায়নি তাঁকে। বরং দলের কর্মীদের বারবার সংগঠন মজবুত করায় জোর দিতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করার কথা বলে গেলেন। অন্য দিকে, বিজেপি-র কর্মিসভায় দুধকুমারের বক্তৃতায় বারবারই উঠে এল শাসকদলের প্রসঙ্গ। অনুব্রত, মনিরুল ইসলাম, আরাবুলদের সমালোচনা থেকে পাড়ুই, ইলামবাজার, নানুর এলাকায় তৃণমূলের সন্ত্রাসের কথা বলে গেলেন তিনি। আর বারবার বললেন দলে সদস্য বাড়াতে হবে। কিন্তু সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি কথাও তাঁকে বলতে শোনা গেল না। আক্ষেপ দলের অনেক কর্মীরও। ওই বিজেপি কর্মীদের কথায়, “রামপুরহাট পুরসভা রামপুরহাট ১ ব্লকের অধীনে। পুরভোটের আগে এতবড় কর্মিসভায় শহরের কর্মীদের ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে দুধকুমারদা কোনও নির্দেশই দিলেন না। তিনি শুধু বিধানসভা ভোটের জন্য সদস্য বাড়াতে বলে গেলেন। অথচ শহরের বাইরের এলাকার কর্মীদের নিয়ে সভায় অনুব্রত বলে গিয়েছেন, তাঁরা যেন রামপুরহাট শহরে থাকা তাঁদের আত্মীয়-বন্ধুদের তৃণমূলকেই যেন ভোট দিতে বলেন। কত তফাত্‌।”

শুধু তাই নয়। তৃণমূলের কর্মিসভায় রামপুরহাট ২ ব্লকের ৯টি পঞ্চায়েতের অঞ্চল সভাপতি ও বুথ কমিটির সভাপতিরা ছিলেন। অনুব্রত অঞ্চল ও বুথ সভাপতিদের রীতিমতো পড়া ধরার মতো ক্লাস নিয়েছেন। বুথে ভোটার সংখ্যা, মহিলা ভোটার, সংখ্যালঘু ভোটার, তফশিলি জাতি-তফশিলি জনজাতির সংখ্যা এ সব প্রশ্ন তো ছিলই। এমনকী, বুথ সভাপতি বুথে প্রতি মাসে ক’টা মিটিং করেন, এ নিয়েও অনুব্রত খোঁজ নিয়েছেন। আবার তৃণমূল জেলা সভাপতিকে দলীয় কর্মীদের এমন প্রশ্ন করতেও শোনা গিয়েছে যে, বুথ কমিটির সঙ্গে অঞ্চল সভাপতি বা ব্লক সভাপতি যোগাযোগ রাখেন কি না, রাখলে পরস্পর প্রতি মাসে ক’টি মিটিং করেন, সে ক্ষেত্রে দলের কর্মীরা বুথ কমিটি, অঞ্চল কমিটি, ব্লক সভাপতিদের কাছ থেকে কোনও কাজ নিয়ে গেলে কোনও অসুবিধার মধ্যে পড়েন কি না, তা নিয়েও খোলামেলা আলোচনা করেন তিনি। আবার কড়া বার্তা দিতেও ছাড়েননি অনুব্রত। দলীয় কর্মীদের তিনি বলেন, “কোনও অঞ্চল সভাপতি, বুথ সভাপতির কাজ খারাপ দেখতে পেলে তাঁদের বাদ দিতে দল এক মিনিটও সময় নেবে না!” ওই সভা থেকে বেরিয়ে কর্মীদের কয়েকজন তো বলেই ফেললেন, “বাপরে! মনে হচ্ছিল যেন স্কুলে ঢুকেছি। কেষ্টদা যা সব প্রশ্ন করছিলেন!”

উল্টো দিকে, দলের সংগঠন বৃদ্ধির উপায় নিয়ে আলোচনার বদলে বিরোধী দলের সমালোচনার কথাই বেশি শোনা গেল বিজেপি-র কর্মিসভায়। রামপুরহাট ১ ব্লকের ৯টি পঞ্চায়েতের অঞ্চল সভাপতিরা তাঁদের সদস্য সংখ্যা নিয়ে দুধকুমারের কাছে যখন রিপোর্ট করলেন, তখন দুধকুমারকে কোনও প্রশ্ন করতে দেখা গেল না। কেন সদস্য সংখ্যা কম, তা নিয়েও দলীয় কর্মীদের কোনও জবাবদিহিও করতে হল না। তাই সভার পরে অনেকটা স্বস্তিতে দেখা যায় বিজেপি নেতাদের।

পরে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে দু’দলের সাংগঠনিক শক্তির ফারাকের কথা অস্বীকার করেননি দুধকুমারবাবু। তবে, তাঁর যুক্তি, “দু’দলের সাংগঠনিক চেহারা আলাদা। তাই দু’দলের কর্মিসভার নিরিখে এমন তুলনা টানার কোনও মানে হয় না। আমরা এটুকু বলতে পারি, দলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছি। তার জন্য যা যা প্রয়োজন, করা হচ্ছে। আগামী ২০ মার্চের মধ্যে আমরা পুরসভার প্রার্থী তালিকাও ঘোষণা করে দেব।” কিন্তু নির্বাচন লড়বেন কী ভাবে? সংগঠন জোরদার না হলে আখেরে এখানে বনগাঁ-কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচনের ফলের মতো হবে না, আশঙ্কা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে।

আর তৃণমূলের সেনাপতি অনুব্রত বলছেন, “এ ভাবে বুথ কর্মীদের নিয়ে মিলিত না হলে হবে কী করে? বুথের সভাপতিরা হচ্ছেন দলের হাতিয়ার। দলের সভাপতি হিসেবে বছরে এক বার-দু’বার তাঁদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা আমি করি। তবে, এটা নতুন নয়। ২০০৮ সাল থেকেই আমি এটা করে আসছি। ফলও পাচ্ছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE