Advertisement
E-Paper

প্যাটিস পার্টি বরাবরই ‘ফেভারিট’

যাঁরা ভাবেন, শান্তিনিকেতন মানেই ‘অ্যাই গরু সর না, ফুল ছুড়ে মারব’— তাঁরা এই শহর সম্পর্কে কিস্যু জানেন না। প্রেমের ব্যাপারে শুধু কলকাতা কেন, দেশের যে কোনও শহরের চাইতে বহু কিলোমিটার এগিয়ে শান্তিনিকেতন। ভারতের ইতিহাসে আর কোনও শহর সফল প্রেমিক আর ব্যর্থ প্রেমিকদের ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছে? শান্তিনিকেতন দেখেছে। ২০০১-০২ সালে পূর্বপল্লির মাঠে ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে ‘লাভার্স ইউনিয়ন’ (প্রেমে সফল) বনাম ‘প্যাটিস পার্টি’ (প্রেমে ব্যর্থ)- ওয়ান ডে ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছে পরপর কয়েক বছর।

আবীর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী

ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী

যাঁরা ভাবেন, শান্তিনিকেতন মানেই ‘অ্যাই গরু সর না, ফুল ছুড়ে মারব’— তাঁরা এই শহর সম্পর্কে কিস্যু জানেন না। প্রেমের ব্যাপারে শুধু কলকাতা কেন, দেশের যে কোনও শহরের চাইতে বহু কিলোমিটার এগিয়ে শান্তিনিকেতন।

ভারতের ইতিহাসে আর কোনও শহর সফল প্রেমিক আর ব্যর্থ প্রেমিকদের ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছে? শান্তিনিকেতন দেখেছে। ২০০১-০২ সালে পূর্বপল্লির মাঠে ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে ‘লাভার্স ইউনিয়ন’ (প্রেমে সফল) বনাম ‘প্যাটিস পার্টি’ (প্রেমে ব্যর্থ)- ওয়ান ডে ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছে পরপর কয়েক বছর। সেই ম্যাচে ইউনিয়ন দলের ক্যাপ্টেন হওয়ার যোগ্যতা ছিল কমপক্ষে তিনটি প্রেমের অভিজ্ঞতা। আর প্যাটিস-অধিনায়ক হতেন পূর্বপল্লি বয়েজ হস্টেলের সুবিদিত কোনও ‘দেবদাস’। সেই সব ম্যাচে খেলোয়াড়দের উত্‌সাহ দিতে আসত বিশ্বভারতীর বিভিন্ন ভবন থেকে প্রেমিকা আর বান্ধবীরা। মাঠের বাইরে থেকে তারা সিটি বাজিয়ে উত্‌সাহ দিত ক্রিকেটারদের। সে অভিজ্ঞতার কথা আজও ভোলেননি বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের প্রাক্তনী আবীর কর। লাভার্স ইউনিয়নের হয়ে ১১ রান করেছিলেন। বললেন, “দর্শকদের সহানুভূতিটা কিন্তু বেশি ছিল প্যাটিসদের দিকেই।”

কেবল তাই নয়, কলাভবন এখনও প্রতি ১৪ ফেব্রুয়ারি ভবনের চাতালে একটি কার্ডবোর্ডের বাক্স রাখে। গ্রাফিতির আঁকিবুঁকিতে সাজানো সেই বাক্সের নাম ‘প্যান্ডোরা বাক্স।’ বিভিন্ন ভবনের ছাত্রছাত্রীরা সে বাক্সের মধ্যে প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে ফেলে যায়। সে চিঠি হয়তো পেন্টিংয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে লেখা সেরামিকের কোনও সিনিয়রের। অথবা, সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর ছাত্রকে সঙ্গীতভবনের রবীন্দ্রনৃত্যের কোনও ছাত্রীর না-পাঠানো ভালবাসার চিঠি। প্রেম দিবসের রাতেই সে সব চিঠি পড়ে ফেলা হয় সকলে মিলে। চাঁদের আলোয় এক-একটি চিঠি খোলা হয় আর শোনা যায়, “শিলিগুড়ি থেকে পড়তে আসা কোঁকড়া-চুলের মেয়েটি, ফকির তোমাকে দেখেই ভালবেসেছে।” গান-গল্পে-আড্ডায় প্রেমকে এমনভাবে ‘শেয়ার’ করে নিতে পারে আর কোন প্রতিষ্ঠান?

অথচ ‘ন্যাকা ন্যাকা প্রেম’ কথাটার সঙ্গে কেমন করে যেন শান্তিনিকেতনের নাম জুড়ে গিয়েছে। সেটা হয়তো স্থানীয় প্রকৃতির স্নিগ্ধতার সঙ্গে মিল রেখেই। আসল কথা হল, শান্তিনিকেতন সময়ের আগে ভাবে। বিশ্বভারতীর সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের অধ্যাপক মানস রায় বলেন, “রবীন্দ্রনাথ অনেক আধুনিক ছিলেন। তিনি প্রেমের সম্পর্ক দেখে ভুরু কুঁচকোনর পক্ষপাতী ছিলেন না। আজও তিনি থাকলে প্রথাবিরুদ্ধ প্রেমের সম্পর্ককে প্রশ্রয়ই দিতেন।”

সে যুগে প্রেম করার জায়গাও কম ছিল না। সিংহসদনের জানলার রোয়াক, পুরনো বাংলা বিভাগের সামনের ছাতা, কিংবা নিভৃত আশ্রমমাঠ-আম্রকুঞ্জ। সকাল, দুপুর সন্ধ্যায় আড়াল খোঁজার জায়গার অভাব ছিল না। সম্পর্ক আরেকটু এগোলে যুগলেরা যেত খোয়াই-কোপাই, না হলে আমার কুটির। ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে-র সকাল থেকেই এ সব এলাকার আনাচকানাচে চলত একটু নিরিবিলির তল্লাশি।

শান্তিনিকেতনে সরস্বতী পুজো না থাকায়, প্রেমদিবস হিসেবে ভি-ডে বরাবরই খুব জনপ্রিয়। এক দশক আগেও, যখন ১৪ ফেব্রুয়ারি এত বাজার-নির্ভর হয়ে ওঠেনি, সুনীল-শক্তির কবিতা টুকে কিংবা গীতবিতান থেকে প্রিয় গানের কথায় সাজানো হাতে-আঁকা কার্ড দেওয়ার রীতি ছিল শান্তিনিকেতনে। তবে, প্রেম নিবেদনে নতুনত্ব আনতে গোলাপ বাদ দিয়ে কেউ কেউ ঘাসফুল দিয়েও প্রেম নিবেদন করত। চেনা ঠেক ছেড়ে নতুন কোথাও ঠেক জমাত যুগলবৃন্দরা।

বহু প্রজন্ম ধরে প্রেম করার এমন ধারা নিরুদ্বেগে চলে আসছে শান্তিনিকেতনে। এখন পরিবর্তন কী হয়েছে? যদি কিছু হয়ে থাকে, তবে ভালবাসা আরও খোলাখুলি প্রকাশের সাহসে। পরস্পর কোমর জড়িয়ে তরুণ-তরুণীর হেঁটে যাওয়া এখন চমকে-দেওয়া দৃশ্য নয় আর। বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, পূর্ণিদেবী চৌধুরী মহিলা কলেজের ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপিকা শাহনাজ বেগমের যুক্তি, “শান্তিনিকেতনের এই প্রজন্মের মেয়েরা অক্লেশে প্রেমিককে কফি খেতে যাওয়ার কথা বলে। লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেমের দিন শেষ।” সমাজের যে কোনও প্রশ্নে প্রতিবাদ করতে হলে এখন শান্তিনিকেতনের যুগলরা হাতে-হাত ধরে পথে নামে, এটাও তাঁর কাছে উল্লেখযোগ্য। “প্রসঙ্গ ওয়ালস্ট্রিট হোক অথবা যাদবপুর, সাম্প্রতিক সময়ে তার নজির রয়েছে,” বলেন তিনি। পাঠভবন থেকে পড়ছেন বিশ্বভারতীতে, এখন অর্থনীতির ছাত্রী হিমাদ্রিজা মনে করিয়ে দিলেন সুমনের গানের কথা, ‘ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড কর, প্রেমের পদ্যটাই বিদ্রোহ, আর চুমুর দিব্যি, শুধু তোমাকেই চাই।’ তাঁর সংযোজন, “প্রেম তো অপরাধ নয়, যে ন্যাক্যা ন্যাক্যা শিলমোহর দিয়ে গোপনে প্রেম করব। বলতে পারেন, সুমনের ওই কথাগুলোই এখন শান্তিনিকেতনী প্রেম ও প্রতিবাদের ট্যাগ লাইন!”

তবে প্রকাশ্যে চুমুতে এখনও প্রোমোশন পায়নি বাসন্তিক শান্তিনিকেতন। মাস দেড়েক আগে নীতি পুলিশের বিরুদ্ধে, কোচিতে তরুণ-তরুণীর প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার প্রতিবাদে এক রাজনৈতিক দলের ‘দাদাগিরি’র বিরুদ্ধে, কিংবা কলকাতার স্টার থিয়েটারে ছোট পোশাক পরিহিত এক তরুণীকে ঢুকতে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে, ‘চুমু আন্দোলনে’ শামিল হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তাঁরা ‘হোক কলরব’-এর সঙ্গে মিল রেখে নাম রেখেছিল ‘হোক চুম্বন’। তাঁদের স্লোগান ছিল, “আমার শরীর আমার মন, দূর হটো রাজশাসন।” ফেসবুকে সে আন্দোলনকে সমর্থন জানায় শান্তিনিকেতনও।

“দিন কাল বদলেছে প্রেম অথবা প্রতিবাদের ভাষাও তাই বদলে গিয়েছে। যাদবপুরের পাশে দাঁড়িয়ে শান্তিনিকেতনে আমরা এখন ভরসা রাখি চুমুর দিব্যিতে,” বলেন শিক্ষাভবনের রসায়নের ছাত্র মাসুদ রাইহান। তা বলে প্রকাশ্যে চুমু খায়নি শান্তিনিকেতনের যুগলরা। সে দিনও আসবে নিশ্চয়ই।

বসন্ত এসে গেছে।

abir mukhopadhyay amar shahor valentine's day shantiniketan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy