শূন্য আসন। ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
সে কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভুবনডাঙার কালোর দোকান। বাংলা বিভাগের শিমূলতলাতেও কেউ আর ভিড় করে না। পুনর্মিলনে বাউলমঞ্চের অদূরে, পৌষের মিঠে রোদে বসে স্মৃতির সরণিতে কেউ হাঁটে না গানে-গল্পে। চিনে বাদামের খোলা ভাঙতে ভাঙতে পূর্বপল্লির মাঠের বদলে, নতুন প্রজন্ম এখন কথা বলে ফেসবুক কিংবা হোয়াটস্অ্যাপের গ্রুপ চ্যাটেই!
বস্তুত, পৌষমেলার মাঠ থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শান্তিনিকেতনের আড্ডার চেনা ছবি। মেলাকে কেন্দ্র করে ফি বছর ‘সেঁজুতি’ বা ‘১৪০০ সাহিত্য’র মতো স্টলে যে নির্মল আড্ডা জমে, নতুন প্রজন্ম উধাও সে আসর থেকে। অথচ মাত্র এক দশক আগেও ছবিটা ছিল অন্য রকম। প্রাক্তনী ও নবীনদের গানে-গল্পে এই সব মজলিশি ঠেকে দুপুর গড়িয়ে রাত নামত। একটু বেশি রাতে আসতেন ‘সেলেব্রিটি’ প্রাক্তনীরাও।
মেলা যখন উত্তরায়ণ সংলগ্ন মাঠে বসত, তখন থেকেই আশ্রম সদস্যদের কাছে তা ছিল কয়েক দিনের জমাটি আড্ডা আর পুনর্মিলনের উৎসব। আশ্রমিক সঙ্ঘের স্টলে নৃত্য ও গানে সকলে মাতোয়ারা হতেন বেশি। এমন এক পৌষ উৎসবেই জীবনে প্রথম শান্তিনিকেতন আসেন বিশিষ্ট শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস। তাঁকে ঘিরে বসত জমাটি আসর। প্রবীন আশ্রমিকেরা জানান, জর্জদা গেয়েছিলেন হিমাংশু দত্তের সুর করা দু’টি গান। সঙ্গে বেশ কয়েকটি শচীনকর্তার গান। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষের ভিড়ও এসে ঠেকত এই সব মেলা-ঠেকে। এমনই এক জনপ্রিয় ঠেক ছিল ‘কালোর দোকান’। ভিড় সরিয়ে তুমুল আড্ডার জন্য জনপ্রিয় ছিল যে সমস্ত স্টলগুলি, তার মধ্যে এই কালোর দোকান ছিল রীতিমতো তারকাখচিত। ১৯৫২ সালে রতনপল্লিতে কালীপদ দলুই তাঁর চায়ের দোকানটি খুললেও প্রতি বার মেলায় স্টল দিতেন। পরে কালীপদবাবুর ছেলে মদন দলুই স্টল নিয়ে আসতেন মেলার মাঠে। বিশিষ্ট জনের স্মৃতিকথাতেও রয়েছে সেই সব পৌষ উৎসবের দিনের কথা। পূর্বপল্লির মাঠে মেলা উঠে আসার পরে এই দোকানটিতেই ভিড় জমত প্রাক্তনী ও নবীনদের। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, সেই ভিড়ে নবীন প্রজন্মের মুখ কমেছে।
সে দিক থেকে দেখলে, তিন বছর আগে কালোর দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এখন একমাত্র আড্ডার জায়গা ‘সেঁজুতি’। পুনর্মিলন ও আড্ডার ভাবনা থেকে ৭০ সালে শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনীরা মেলার মাঠে এই স্টল শুরু করেছিলেন। একবার সত্যজি রায় মেলায় ঢুকে চিনির বদলে ভুল করে নুন দেওয়া কফি খেয়ে গিয়েছিলেন এখানেই! সে বারের ভুলের জন্য অবশ্য আজও ক্ষমাপ্রার্থী সেঁজুতির সদস্যেরা। শুরুর সে দিনের কথা বলছিলেন প্রবীণ সদস্য পবিত্র মুখোপাধ্যায়। “বিক্রি বাটা করে লাভ করতে নয়, প্রাক্তনীরা সে দিন এই স্টল খুলেছিল নবীন ও প্রবীণের এক সঙ্গে বসে আড্ডার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এখন পৌষমেলায় এসে যাঁরা এখানে আড্ডা দিতে আসে, তাঁদের কেউ নবীন নন,” আক্ষেপ পবিত্রবাবুর। আর এক সদস্য শান্তি মিত্র আবার বললেন, “শুরুর দিন থেকে আছি। এখন কমতে কমতে পঁচিশ জনে এসে ঠেকেছি। সব চেয়ে কনিষ্ঠ সদস্যের বয়স ৪২!”
শুক্রবার শেষবেলার মেলাতে ‘সেঁজুতি’তে এসেও নতুনদের দেখা মিলল না। কেন তাঁরা মেলার এই সুবিদিত আড্ডা জোনে নেই?
অনেকে চাঁদের হাট-স্টলের কথাও বলতে চান। কয়েক বছর আগে শর্মিলা রায় পোমো এবং শ্রীলা চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই স্টলটি শুরু হয়। কিন্তু, সেখানে শান্তিনিকেতনে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিমেদুর আড্ডার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থাকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। একক সঙ্গীত, পাঠ, বক্তব্যের তিন দিনের সূচিতে ঠাঁসা থাকে ওই অনুষ্ঠান। চাঁদের হাটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শিবাদিত্য সেন বলছেন, ‘‘ঠিক আড্ডা নয়, এখানে আগে থেকে ঠিক করা হয় অনুষ্ঠান সূচি। নতুনরাও এখানে আসে। কারণ, নিজেদের কাজ তুলে ধরার তাঁরা একটা জায়গা পান। সে লিটিল ম্যাগাজিনই হোক বা গান।”
মেলাকে উপলক্ষ্য করে কয়েক বছর আগেও স্রেফ পুনর্মিলন ও আড্ডার জন্য বিশ্বভারতীর বিভিন্ন ভবন দেখা করত একসঙ্গে। এদের মধ্যে ছিল শিক্ষাভবন, কলাভবন বা সঙ্গীতভবনের মতো ভবনগুলি। বাংলা বিভাগের একটি ব্যাচ যেমন দেখা করত পুরনো বিদ্যাভবনের শিমূলতলাতে। তাঁরা ‘শিমূল’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। তাঁর সম্পাদক আবীর কর বলেন, “শেষের দিকে অনেকেই উৎসাহটা হারিয়ে ফেলছিল। আর নতুনরা ঠিক মেলাতে পারছিল না। ফেলে আসা সময়ের মজলিশি মেজাজের সঙ্গে শেষে সেই আড্ডাও থেমে গেল। বন্ধ হল শিমূলের প্রকাশ।’’ রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ প্রামাণিক, জয়দেব মিশ্রদের মতো কয়েক জন প্রাক্তনীর কথায় জানা গেল, পৌষের মিঠে রোদে পিঠ রেখে মেলার আড্ডা-ছবি হারালেও ইদানিং ‘ভার্চুয়াল-আড্ডা’ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ব্যাচের মধ্যে ১৯৯৫ সালে যাঁরা পাঠভবন থেকে পাশ করেছেন, অথবা শিক্ষাসত্র ২০০০ সালের ব্যাচ, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক রেখে চলেছে হোয়্যাটস্অ্যাপের নিজস্ব গ্রুপে। মেলায় সকলের সঙ্গে সকলের দেখা না হলেও এখন কথা হয় সেই সব গ্রুপে। একে অপরের ফেসবুকে দেওয়া মেলার ছবিতে তাঁরা লাইক আর কমেন্টে মাতেন।
কী বলছে বিশ্বভারতীর বর্তমান প্রজন্ম?
বিশ্বভারতীর সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী এষা চক্রবর্তী বলেন, “আড্ডা হয়তো হারিয়েছে। কিন্তু, সাইবার দুনিয়ায় যোগাযোগও বেড়েছে। তাই পৌষমেলার মাঠে না হলেও, এখনও তুলকালাম আড্ডা চলে নানা ব্যাচের মধ্যে। অনেকে না এসেও তাতে যোগ দিচ্ছে।” পবিত্রবাবু, শান্তিবাবুদের অবশ্য ব্যাখ্যা, “নতুন প্রজন্মের হাতে সময় কোথায়? সকলেই খুব ব্যস্ত।” আর এক প্রাক্তনী, বাংলা বিভাগের নবগোপাল রায় আবার মনে করেন, “আড্ডা মানে নতুন নতুন সর্ম্পকও। আগে প্রাক্তনী ও নবীনদের সম্পর্ক ছিল পারিবারিক। সাইবারে কোথায় সেই প্রাণ!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy