টুসু গান শোনাচ্ছেন রাখহরি মাহাতো। হুড়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
মানভূমের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে পুরুলিয়ার মকর পরবের টুসুগান। গবেষকেরা বলছেন, ফসলের দেবী হিসেবে পুরুলিয়া তথা মানভূমের বিস্তীর্ণ এলাকায় পূজিতা হন টুসু। তুষ অর্থে ধানের খোসা। তুষ থেকে তুষু। এই শব্দ থেকেই টুসু এসেছে। তাই মকর পুরুলিয়ার প্রাণের উৎসব বলা চলে।
স্নান, পিঠে ও টুসুগানই এই উৎসবের অনুষঙ্গ। পুজোর নির্দিষ্ট কোনও মাঙ্গলিক প্রথা নেই। গানই হচ্ছে উপাচার। গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “ফসলকে ঘিরেই কো-গ্রাম জীবনের বেঁচে থাকা। সেই ফসল ঘরে তোলার পরে এই উৎসবে মেতে ওঠেন রাঢ়বঙ্গের এই এলাকার মানুষজন। আর টুসুগানে থাকে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপন বা সুখ-দুঃখের কথা। একই সঙ্গে থাকে সমকালীন বিষয়ও। সেই সূত্র ধরেই এ বার টুসুগানের অন্যতম প্রধান বিষয় জঙ্গলমহলের রেলপথ।”
টুসুগানের পরিচিত গীতিকার রাখহরি মাহাতোর আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেলপথ নিয়ে লেখা দু’টি গান মুখে মুখে ঘুরছে অনেকেরই। দেবী টুসুর মুখেই তিনি বলেছেন, ‘আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেলপথের কথা টুসু বইলতে যাবেক কইলকাতা, এত যে মন্ত্রী-নেতা কেউ শুনে না টুসুর কথা, মিটিং-মিছিল কত হইল সই দিল খাতা খাতা, বান্দোয়ান-আদ্রা পদযাত্রায় টুসুর হৈল পা ব্যাথা। মকরবাসী বইলছে টুসু হাঁইটব দিল্লি কইলকাতা, অনশনে বইসব শেষে না হইলে লাইন পাতা।’ আর একটি গান, ‘মঙ্গল হবেক জঙ্গলমহলে যদ আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেল চলে, দু টাকার চাল তিন টাকার গম ঠিকই আছে দিন চলে।’ গানের কথায় গীতিকার বলতে চেয়েছেন, যোগাযোগের জন্য এলাকায় ভরসা বলতে বাস। বন্ধ হলে, বাস বন্ধ ফলে বন্ধ রুজিও। ধানভরা মাঠ, বন থাকা সত্ত্বেও ধনবতী মায়ের ছেলে খাটছে মুম্বই-কেরলে। গীতিকারের কথায়, রাখহরি গানে গানে রেলপথের দাবি তোলে, জঙ্গলবাসী চাষিবাসী সুর লাগাও তালে তালে।
ইতিমধ্যেই গানগুলি রেকর্ড করে প্রদর্শিত হচ্ছে স্থানীয় দু-একটি চ্যানেলে। আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেলপথ নির্মাণ সংগ্রাম সমিতির মুখপাত্র আনন্দময় সেন বলেন, “রাখহরি মাহাতোর এই রেলপথ গড়াকে ঘিরে এই গানগুলি জঙ্গলমহলের মুখে মুখে ঘুরছে। টুসু তো মানভূমের প্রাণের পরব। আমরা আগামীদিনে এই গান রেকর্ড করে জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছে দেব।” বান্দোয়ান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ভবানী মাহাতো বলেন, “আমি গানগুলি শুনেছি। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তা ছাড়া গানের এই কথাগুলি মানুষজনের অন্তরের কথা। এই রেলপথ গড়ার দাবিও তো অনেকদিনের।” এই গানগুলি রেকর্ড করেছেন বাঁকুড়ার সিমলাপালের বাসিন্দা সুনীলবরন মাহাতো। তিনি টুসু বা ঝুমুর গানের শিল্পী হিসেবে জঙ্গলমহলে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে জেলার বিশিষ্ট লোক গবেষক দিলীপ গোস্বামী বলেন, “পুরুলিয়া তো একদা বিহার প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলায় যুক্ত হওয়ার পিছনে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল লোকসেবক সঙ্ঘ। মানভূমের বিস্তীর্ণ এলাকায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে লোকসেবক সঙ্ঘ হাতিয়ার করেছিল টুসু গানকে। পুরুলিয়ার প্রথম সাংসদ (দক্ষিণ মানভূম সংসদীয় আসন) ভজহরি মাহাতোর লেখা গান, ‘শুন বিহারী ভাই তোরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাঁই....’ এই গানটি ছিল ওই আন্দোলনের থিম সং।”
জানা গিয়েছে, তৎকালীন বিহার সরকারের হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই গানে তখন মানভূম উত্তাল। এখন যেখানে আদালত, তখন তার সামনে একটি ফাঁকা মাঠ ছিল। সেই মাঠে টুসু গান গাওয়া হয় মকর পরবের সময়। এই মাঠে বা অন্যত্র এই গান গাইলেই বিহার সরকারের আক্রমন শুরু হল। গ্রেফতার শুরু হল। এই গান লেখার জন্য সাংসদ ভজহরি মাহাতোকে গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকে তাঁকে কোমরে দড়ি পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদও হয়। এই গান সম্বলিত টুসুগানের বই-এর একলক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। আসলে গানের কথার মধ্যে মানুষজনের মনের কথা নিহিত ছিল। আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে এই গানও অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে বলে মনে করছেন লোক গবেষকেরা। এই রেলপথ হলে ওই এলাকার অর্থনীতিটাই বদলে যাবে। কুড়মালি ভাষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত অনুবাদ করে মানভূমের নজরকাড়া কুড়মালি ভাষার কবি সুনীল মাহাতোর কথায়, “আমি রাখহরির লেখা গানগুলি পড়েছি। খুবই শক্তিশালী। আর মানভূমের টুসুগান তো পুরুলিয়াবাসীর কাছে প্রাণের গান। আমি চ্যানেলেও দেখেছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy