বাঁকুড়া সদর থানায় আটক করা মাইক ও সাউন্ডবক্স।—নিজস্ব চিত্র
পুজো-পার্বণ মানেই মাইক ও সাউন্ডবক্সের দাপাদাপি। বাঁকুড়াবাসীর কাছে এটা নতুন কিছু নয়। তারস্বরে মাইক, সাউন্ডবক্স বাজলেও এক দিন ধরে পুলিশকর্মীদের নীরব দর্শকের ভূমিকাতেই দেখতে অভ্যস্ত এলাকার বাসিন্দারা। দীর্ঘদিনের চেনা এই দৃশ্য বদলে গেল শনিবার। শহরের লালবাজারে সন্তোষী পুজোর ভাসানে বেআইনি ভাবে মাইক বাজানোর অভিযোগে ধরপাকড় চালালো পুলিশ। আটক করল মাইক, গ্রেফতার করা হল তিন যুবককে।
ওই দিন দুপুরে থানা থেকে শহর পরিক্রমা করতে বেরিয়েছিলেন বাঁকুড়া সদর থানার আইসি বিশ্বজিৎ সাহা। সঙ্গে ছিলেন দু’জন এনভিএফ কর্মী। লালবাজার রোড হয়ে যাওয়ার সময় সন্তোষী পুজোর ভাসানের মিছিলের সামনে পড়েন তাঁরা। ৮টি মাইক ও ১৮টি স্পিকারের দু’টি সাউন্ডবক্স (শহরের মনসা পুজোয় এই দৃশ্য অতি পরিচিত) একটি ভ্যানে তুলে প্রায় একশো জন রাস্তায় নাচতে নাচতে মিছিলে যাচ্ছিলেন। বিশ্বজিৎবাবু গাড়ি থামিয়ে ছ’টি মাইক ও একটি সাউন্ডবক্স বন্ধ করতে বলেন। পুলিশের দাবি, ভাসানে উপস্থিত লোকজন তাতে আপত্তি জানায়। মাইক খুলতে বলায় উল্টে আইসি ও এনভিএফ কর্মীদের পাল্টা হুমকি দিতে থাকে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আইসিকে বদলি করে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন ভাসানে উপস্থিত কিছু লোকজন। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে দেখে বিশ্বজিৎবাবু থানায় ফোন করে আরও পুলিশ কর্মীদের ঘটনাস্থলে পাঠাতে নির্দেশ দেন। পুলিশের গাড়ি ঢুকছে দেখে ভাসানে উপস্থিত লোকজন এ-দিক ও-দিক দৌড়তে শুরু করেন। ওই পুজো কমিটির সদস্য অভিজিৎ মালাকারকে আটক করা হয়। তাঁকে ছাড়াতে গিয়ে ধরা পড়েন লাল্টু মালাকার ও বিশ্বজিৎ রুইদাস। সেই সঙ্গে মাইক ও সাউন্ডবক্সগুলি আটক করে পুলিশ।
অভিজিৎ ও লাল্টু লালবাজার রাউতপাড়া এলাকার বাসিন্দা এবং বিশ্বজিতের বাড়ি কেরানিবাঁধের হাড়িপাড়ায়। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া ও কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর উপরে চড়াও হওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রাউতপুকুর এলাকার এই পুজো বহু পুরনো হলেও গত কয়েক বছর এই পুজোর আড়ম্বর আগের থেকে বেড়েছে। ওই দিনের ঘটনা নিয়ে পুজো কমিটির সদস্যরা কিছু মন্তব্য করতে চাননি। তবে এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, মদ্যপ অবস্থায় ভাসানে উপস্থিত কয়েক জন পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়াতেই বিষয়টি এতদূর গড়ালো। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দিনের বেলায় মাইক বাজানোর ক্ষেত্রে ১৫০ ডেসিমেল ও রাতে ১৪০ ডেসিমেল পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁকুড়া শহরের কোনও পুজো-পার্বণে এই আইন মানা হয় না। রাত ১০টার পর এমনিতেই মাইক বাজানোর নিয়ম নেই। সেখানে মনসাপুজার মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সারা রাত ধরেই মাইক তারস্বরে বাজতে থাকে। মাইকের আওয়াজে কাঁপতে থাকে বাঁকুড়া শহরের বিভিন্ন পাড়া এলাকা। বার বার এর বিরুদ্ধে শহরের মানুষেরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কাছেও লিখিত আবেদন জানিয়ে মাইক বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু কোনও মহল থেকেই সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ।
তবে শনিবারের ঘটনাকে একটা শুভ ইঙ্গিত বলেই ধরছেন শহরবাসীদের একাংশ। গত অগস্টেই শব্দ দূষণে অতিষ্ট শহরের বেশ কিছু মানুষ ‘আমরা সবাই একসাথে’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে মাইকের আওয়াজে লাগাম টানার দাবি জানিয়েছিলেন। শনিবারের ঘটনা নিয়ে ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সমীরণ সেনগুপ্ত বলেন, “আইসির পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তবে এই সব রুখতে ধরপাকড়ের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার কাজও জারি রাখতে হবে।” শব্দ আইন রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত বাঁকুড়া চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন দরিপা। বলেন, “মনসা পুজোর সময় মাইকের শব্দে শহরে টেকা দায় হয়ে যায়। বিশেষ করে বৃদ্ধ অসুস্থ বা শিশুদের পক্ষে খুবই মুশকিল হয়। আমরা বছরের পর বছর ধরে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছি। তবু পরিস্থিতি বদলায়নি। পুলিশের এই পদক্ষেপ জারি থাকলে হয়তো শব্দ দানবের হাত থেকে রক্ষা পাবে শহরবাসী।”
আইন ভেঙে কেউ মাইক বাজালে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy