Advertisement
১০ মে ২০২৪

রাসমঞ্চের কাছে বেআইনি মোবাইল টাওয়ার, ক্ষোভ

মল্লরাজাদের তৈরি বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চের মাত্র ১২০ মিটারের মধ্যেই একটি মোবাইল টাওয়ার তৈরি হয়েছে বিষ্ণুপুরে। পাথরের চাতালের উপরে ১০৮ দরজার ইটের তৈরি এই রাসমঞ্চ শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় মন্দির শৈলিরই একটি অনন্য নিদর্শন।

ওই টাওয়ার নিয়ে ক্ষোভ।—নিজস্ব চিত্র।

ওই টাওয়ার নিয়ে ক্ষোভ।—নিজস্ব চিত্র।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০২:২৭
Share: Save:

মল্লরাজাদের তৈরি বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চের মাত্র ১২০ মিটারের মধ্যেই একটি মোবাইল টাওয়ার তৈরি হয়েছে বিষ্ণুপুরে। পাথরের চাতালের উপরে ১০৮ দরজার ইটের তৈরি এই রাসমঞ্চ শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় মন্দির শৈলিরই একটি অনন্য নিদর্শন। মূল আকৃতি পিরামিডের। তার সামনের বাংলা চালা রীতির রূপায়ণ রয়েছে।

১৬০০ খ্রিস্টাব্দে বীর হাম্বিরের তৈরি এই রাসমঞ্চ ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ অধিগৃহীত পুরাস্থাপত্য। সে কালে রাসোত্‌সবের সময় স্থানীয় মন্দিরগুলি থেকে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ এখানে নিয়ে আসা হত। সর্বেক্ষণের নিয়ম মতো, এই স্থাপত্যের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও নির্মাণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পরবর্তী ২০০ মিটারের মধ্যে কোনও নির্মাণ বা খনন করতে গেলে ‘ন্যাশনাল মনুমেন্ট অথরিটি’র অনুমতি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সেই অনুমতিও নেওয়া হয়নি। সর্বেক্ষণের কলকাতা চক্রের সুপারিন্টেডিং আর্কিওলজিস্ট অশোককুমার পটেল জানান, রাসমঞ্চের উত্তর দিকে ১২০ মিটার দূরে মোবাইল টাওয়ারটি বসানো হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। তিনি বলেন, “পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে লিখিত ভাবে ব্যবস্থা নিতে জানিয়েছি।” প্রশাসনও ওই মোবাইল টাওয়ারে সংযোগ দেওয়ার কাজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। অশোকবাবু বলেন, “এই নির্মাণের ফলে প্রাচীন ওই স্থাপত্যের যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শহরের মাঝে সকলের চোখ এড়িয়ে কী ভাবে ধাপে ধাপে এই অবৈধ নির্মাণ গড়ে উঠল বুঝতে পারছি না।” একই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও।

টাওয়ারটি বসানো নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে পুরসভাও। যে জমিতে ওই টাওয়ার বসানো হয়েছে তার মালিক প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষিকা। তবে তাঁর জামাই গৌতম চক্রবর্তী দাবি করেন, শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় তিনিই সম্পত্তি দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, “টাওয়ার বসাতে ওই দেড় কাঠা জমি আমরা একটি বেসরকারি মোবাইল সংস্থাকে লিজ দিয়েছি।” তাঁর বক্তব্য, ওই মোবাইল সংস্থা পুরসভা থেকে ওই টাওয়ার বসাতে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ নিয়েছে। ওই সংস্থার এক মুখপাত্রও একই দাবি করেছেন। কিন্তু বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “রাসমঞ্চের পাশে টাওয়ার নির্মাণের কোনও অনুমতিই পুরসভা দেয়নি।” রাসমঞ্চটি বিষ্ণুপুরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর ময়না লোহারের দাবি, ওই মোবাইল সংস্থাকে ওই এলাকায় টাওয়ার বসানোর ছাড়পত্র পুরসভা থেকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু সকলের চোখের সামনে কী করে ওই টাওয়ার তৈরি হয়ে গেল? ময়নাদেবীর বক্তব্য, কিছুদিন বাইরে থাকায় টাওয়ার যে বসানো হচ্ছে তা তাঁর নজরে আসেনি। তিনি বলেন, “জানতে পেরেই পুরসভাকে নির্মাণ করতে বলি।”

বিষ্ণুপুরের মহকুমা পুলিশ আধিকারিক পরাগ ঘোষ জানান, কাজ বন্ধ করে দিয়ে ওই টাওয়ারের উপর নজর রাখা হচ্ছে।” ওই মোবাইল সংস্থার মুখপাত্র অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা ন্যাশনাল মনুমেন্ট অথরিটির কাছ থেকে টাওয়ারটি চালু করার জন্য অনুমতি চেয়ে নতুন করে আবেদন করেছেন।

মন্দির নগরী বিষ্ণুপুরে আরও বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপত্য মাটি ও জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে বিপন্ন। একসময় শত্রুর হাত থেকে রাজধানী রক্ষা করতে শহরের চারপাশে পরিখা কেটেছিলেন মল্লরাজারা। যার চিহ্ন ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে মাটি ও জমি মাফিয়ারা। সেই সব এলাকায় গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি। ঐতিহ্যবাহী গুমগড়, গড় দরজার পাশ ঘেঁষে মাটি কাটা শুরু করেছিল মাটি মাফিয়াদের দল। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের আপত্তিতে যদিও বর্তমানে তাতে কিছুটা লাগাম পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, শহরের ঐতিহ্য রক্ষা করতে এখনই কড়া হাতে ব্যবস্থা নেওয়া হলে যে টুকু বেঁচে রয়েছে তা রক্ষা করা সম্ভব হবে। না হলে অবহেলায় হারিয়ে যাবে পূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পুরাতাত্ত্বিক সম্পদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE