Advertisement
২১ মে ২০২৪

অকাল বসন্তেও চিন্তা জমির ভবিষ্যৎ নিয়েই

সকাল সাড়ে দশটা থেকে টিভির সামনে বসে পড়েছিলেন ওঁরা। বাজেমিলিয়া উজ্জ্বল সঙ্ঘের ঘুপচি ক্লাবঘর আর বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ায় কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা মানিক দাসের বাড়ির বসার ঘরে।

উৎসব। সিঙ্গুর-রায় শোনার পরে তৃণমূলকর্মীরা। বুধবার বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ায়। ছবি: দীপঙ্কর দে।

উৎসব। সিঙ্গুর-রায় শোনার পরে তৃণমূলকর্মীরা। বুধবার বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ায়। ছবি: দীপঙ্কর দে।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২৭
Share: Save:

সকাল সাড়ে দশটা থেকে টিভির সামনে বসে পড়েছিলেন ওঁরা। বাজেমিলিয়া উজ্জ্বল সঙ্ঘের ঘুপচি ক্লাবঘর আর বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ায় কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা মানিক দাসের বাড়ির বসার ঘরে। সময় এগোতেই শুরু হল উসখুস! রায় কি ঘোষণা হবে না? বেলা গড়়িয়ে দুপুর! নিউজ চ্যানেলের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকার ধৈর্য আর বুঝি থাকে না! দশ বছর ধরে আক্ষরিক অর্থেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, বারবার সমাধানের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েও আবার ধাক্কা খাওয়া— এমনই কি চলবে তবে? জটলা করা ভিড়টা ক্রমশ হতাশ হতে থাকে।

দুপুর আড়াইটে নাগাদ ব্রেকিং নিউজটা দেখা গেলল ছোট পর্দায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভোজবাজির মতো বদলে গেল ছবিটা। স্বতঃস্ফূর্ত হাততালিতে নিরাশ শরীরগুলো নিমেষে টানটান! গ্রামের ঘরে
ঘরে বেজে উঠছে শাঁখ, উলু। হুড়মুড় করে রাস্তায় বেরিয়ে আসছেন মহিলারা। আবির কেনা হয়েছিল আগের দিনই। না আঁচালে বিশ্বাস নেই বলে এত ক্ষণ বেরোয়নি সে সব। খবরটা ছড়িয়ে পড়ামাত্র বুধবার সিঙ্গুরে অকাল বসন্তোৎসব!

বেড়াবেড়ির শ্যামলী দাসের দেড় বিঘে জমি গিয়েছে। স্বামী এখন ঢালাই কারখানায় কাজ করেন। ছেলেকে ক্লাস নাইনের পরে পড়াতে পারেননি। চিন্তায় চিন্তায় হার্টের রুগি হয়ে গিয়েছেন শ্যামলীও। এ দিন এক গাল হেসে বললেন, ‘‘এই দিনটার অপেক্ষাতেই দশ বছর ধরে ছিলাম। আজ আর কোনও দুঃখ নেই।’’ গোকুল দাসের আড়াই বিঘে জমি ছিল। বললেন, ‘‘পুলিশের মার খেয়ে খোঁড়া হয়ে গিয়েছি। আঙুল বেঁকে গিয়েছে। এত সবের পরে এই রায়ের চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না।’’

কিন্তু জমিটা ফেরানো হবে ঠিক কোন উপায়ে আর সেই জমি নিয়ে কত দূর কী করা যাবে, সেই প্রশ্নগুলোও যে আছে। কারও সন্দেহ, নিজের জমি চেনা যাবে কী করে? কারও চিন্তা, ওই জমিতে কি
আর চাষ করা যাবে? ১২ সপ্তাহের মধ্যে জমি ফেরত দেওয়া সহজ হবে না বলেই মনে করছেন অনেকে।
কারণ, অধিগৃহীত জমির পরিমাণ ৯৯৭.১১ একর। আর জমিদাতার সংখ্যা ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক মিলিয়ে অন্তত ১৪ হাজার ৭০০ জন। ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র আহ্বায়ক তথা হরিপালের বিধায়ক বেচারাম মান্না অবশ্য জানিয়েছেন, আজ, বৃহস্পতিবারই নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁরা বৈঠকে বসছেন। বেচারামবাবুর দাবি, ‘‘কোনও সমস্যা হবে না। ৩৭০০ জন অনিচ্ছুক রয়েছেন। কার কতটা জমি গিয়েছে, সেই তালিকা তৈরি রয়েছে।’’

পাঁচিলঘেরা টাটাদের প্রকল্প এলাকার একাংশেই ধানচাষে ব্যস্ত ছিলেন এক দিনমজুর। ২০০৮ সালে পুজোর আগে টাটা গোষ্ঠী ন্যানো প্রকল্প গুজরাতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করার পর থেকে এ তল্লাটের নিরাপত্তা অনেকটাই শিথিল। লোহার গেটগুলিতে জং ধরেছে। পাঁচিলের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে গরু-বাছুর চরে বেড়ায়। জমা জল দিঘির চেহারা নিয়েছে। দশ বছর আগের বহুফসলি জমি আবার আগের অবস্থায় আদৌ ফিরবে কি, প্রশ্ন তুলেছেন ওই দিনমজুরই। তাঁর কথায়, ‘‘মাত্র কয়েক ফালি জমিতে তো চাষ করছি। বেশির ভাগটাই তো কংক্রিট। সেই কংক্রিট তুলে ফেললেও
লাভ হবে না।’’

তা হলে লাভ? উৎসবমুখর সিঙ্গুর মনে করছে, প্রাথমিক ভাবে এটা নৈতিক জয়। আন্দোলনের জয়। এর পর জমি যদি অন্য কাজে লাগে, আপত্তি নেই! বাজেমিলিয়ার বিশ্বনাথ কোলে যেমন বলেন, ‘‘জমির এখন যা হাল, তাতে শিল্পই ভরসা।’’ বেড়াবেড়ির মানিক দাসের কথায়, ‘‘এক সময়ে জমির জন্য আন্দোলন করেছি। এখন টোটো চালাই। ওই জমিকে চাষের উপযোগী করা আর একটা লড়াই। অত আর ধৈর্য নেই। বরং শিল্প হোক।’’ জমি-আন্দোলনের আর এক নেতা, বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও মানলেন, পুরো জমিতে আর চাষ করা যাবে না। ‘‘বাকি জমিতে শিল্প হতেই পারে। চাইলে টাটারাও করতে পারেন। কারও প্রতি আমাদের কোনও বিদ্বেষ নেই,’’ বললেন তিনি।

‘ইচ্ছুক’রাও খুশি। কারণ, যে কারণে জমি দিয়েছিলেন, সেটা, অর্থাৎ কারখানাটা হয়নি। ক্ষতিপূরণের টাকাও ফেরত দিতে হবে না, বলে দিয়েছে আদালত। ইচ্ছুক বলরাম দাস তাই বলছেন, ‘‘আড়াই বিঘে জমি ছিল। সবাই বলল, কারখানা হবে। তা যখন হলই না, তখন জমি ফেরত পেলেই ভাল।’’ শক্তিপদ বাগ সাত বিঘে জমি দিয়েছিলেন। বললেন, ‘‘সরকারের বিরোধিতায় যেতে চাইনি। যে কারখানার জন্য জমি দেওয়া, যে জমি দিয়ে অনেকের চোখে শত্রু হয়েছি, সেটাই তো হয়নি। তা হলে জমিই ভাল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Singur Mamata Banerjee Land Farmers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE