কাঠফাটা দুপুরে বারাসতের টালিখোলায় ব্যারাকপুর রোডের ধারে একটি গলির কাছে উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন বৃদ্ধ। আদুর গায়ে পৈতে, শীর্ণ দেহ। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে পাড়ায় ঘটে যাওয়া তাণ্ডবের আতঙ্ক কাটেনি তাঁর। সমাজমাধ্যমে আপত্তিকর একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক প্রতিবেশীকে আক্রমণ মেনে নিতে পারেননি বৃদ্ধ। প্রতিবেশী মোবাইল ব্যবহারে দক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে এত বড় ঘটনা ঘটল, বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি।
সমাজমাধ্যমের পোস্টকে কেন্দ্র করে গত বছরও বারাসতের কয়েকটি জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েক জনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ বার গণপিটুনির পিছনে রয়েছে ওই পোস্টকে কেন্দ্র করে ওঠা ‘দেশ-বিরোধিতা’র অভিযোগ। যা নিয়ে উদ্বেগে প্রশাসনও। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তৈরি হওয়া যুদ্ধের পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পরেও এই ধরনের তিনটি ঘটনা ঘটেছে বারাসতে। বাড়িতে চড়াও হয়ে ভাঙচুর, মারধরও করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে হুমকি।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থল যেখানে, সেই এলাকার লোকজনের দাবি, বিশৃঙ্খলাকারীরা বহিরাগত। টালিখোলার আরিফবাড়িতে মঙ্গলবার রাতে যে সংখ্যালঘু পরিবারের উপরে হামলা হয়েছে, তাদের দাবি, অন্য পাড়া থেকে ফোনে সতর্ক করা হয়েছিল, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। ওই বাড়ির গৃহকর্তা ও তাঁর ছেলেকে সেই পোস্টের জন্য পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু মারমুখী জনতার হাত থেকে দু’জনকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রমণের মুখে পড়ে পুলিশও। পুলিশ পৌঁছনোর আগেই বাবা-ছেলেকে মারধর করা হয়। বাড়িতে চলে ভাঙচুর। পুলিশ জানিয়েছে, দত্তপুকুর থেকে হামলাকারীরা এসেছিল। ওই বাড়ি থেকে ছাগল চুরির অভিযোগে এক জন ধরাও পড়েছে।
আবার বারাসতের বিবেকানন্দ রোডে একটি পুরনো মাংসের দোকানও দু’দিন আগে ভাঙচুর করেছে এক ধর্মীয় সংগঠন। পুলিশের দাবি, ওই ঘটনাও সমাজমাধ্যমের পোস্ট নিয়ে। হামলাকারীদের সেই দলেও বিবেকানন্দ রোডের কেউ ছিলেন না বলে দাবি স্থানীয়দের। দেশ-বিরোধী পোস্টের অভিযোগে দোকানি ও তাঁর ছেলেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এখন প্রশ্ন, এই অত্যুৎসাহী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদীরা কারা? স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছেও। ওই দু’টি ঘটনায় ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বারাসত পুলিশ জেলার সুপার প্রতীক্ষা ঝারখরিয়া বলেন, ‘‘আক্রমণকারীরা বহিরাগত। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনার পরে সমাজমাধ্যমের বড় বড় গ্রুপের অ্যাডমিনদের সতর্ক করা হয়েছে। তেমন কিছু দেখলে আমাকে ট্যাগ করতে বলেছি। যাতে আমি জানতে পারি। বিতর্ক তৈরি হতে পারে, এমন পোস্ট না করার জন্য আমরা বার বার সচেতন করছি সবাইকে।’’
বুধবার রাতেও আরিফবাড়ি এলাকায় মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী বাপ্পা ভুঁইয়ার বাড়িতে বিক্ষোভকারীদের একটি বড় দল চড়াও হয়। মৌলালিতে যুদ্ধ-বিরোধিতার পক্ষ নিয়ে পথে নামা লোকজনের দলে ছিলেন বাপ্পার মেয়ে। অভিযোগ, তাঁর পোস্টকে দেশ-বিরোধী বলে দাবি করে বিক্ষোভকারীরা শাসানি দিয়ে গিয়েছে যে, মেয়েকে ক্ষমা চাইতে হবে। আগামী রবিবার বারাসতে বাক্-স্বাধীনতা রক্ষার দাবিতে তাঁরা মিছিল করবেন বলে বাপ্পা জানান।
বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান অশনি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরাও মানুষের কাছে আবেদন করছি, পোস্ট করার ব্যাপারে সতর্ক হোন। বারাসত এ ভাবে আগে অশান্ত হয়নি। গত বছরও ভুয়ো পোস্ট নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। আশা করা যায়, পুলিশ এ বারও শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলাবে।’’ দেগঙ্গা, বারাসত, কদম্বগাছির মতো এলাকায় কিছু আপত্তিকর পোস্ট সমাজমাধ্যমে এখনও ঘুরছে। তা নিয়ে পুলিশে অভিযোগও এসেছে। সূত্রের খবর, কদম্বগাছিতে শাসকদলেরই এক নেতার বাড়িতেও চড়াও হয় বিক্ষোভকারীরা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)