E-Paper

৪০ হাজার দিলেই হাতে ‘আসল’ কার্ড

বাংলাদেশ থেকে এ রাজ্যে এসে ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করাচ্ছেন অনেকে। ভোটার-তালিকায় নামও তুলছেন। কী করে?

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৫ ০৬:১৬

—প্রতীকী চিত্র।

বাইরে ঝকঝকে গ্লো-সাইনবোর্ড, তাতে লেখা ‘ডিজিটাল সেন্টার’। নীচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ‘এখানে ফটোকপি, প্রিন্ট, ছবি-সহ যাবতীয় কাজ করা হয়’। আর এই ‘যাবতীয়’র আড়ালেই লুকিয়ে রহস্য। জাল আধার, ভোটার কার্ডের চক্র কাজ করে সেখানে।

জেলা মুর্শিদাবাদ। জলঙ্গি সীমান্ত। পঞ্চায়েত ঘোষপাড়া। এক সময় চোরাকারবারের দৌলতে সীমান্ত থেকে মেরেকেটে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সেখানে তৈরি হয়েছিল এক ছোট্ট গঞ্জ। সেখানে ব্যবসা এখন মন্দা, দাবি স্থানীয়দের। কিন্তু সেখানে কাচের দরজা লাগিয়ে ঝকঝকে ‘ডিজিটাল সেন্টার’ খুলে বসেছেন এলাকার এক যুবক। ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় করে চোরাপথে সেখানে পৌঁছেছেন বছর আঠাশের ‘কাস্টমার’। যুবক বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার বাংলাবাজারের বাসিন্দা। ছিলেন এ রাজ্যের আত্মীয়ের বাড়িতে। সঙ্গে এলাকায় শাসক দলের এক নেতার সঙ্গী। তিনি আধার কার্ডের প্রসঙ্গ তুলতেই ডিজিটাল সেন্টারের মালিক বলেন, ‘‘ও সব এখন হচ্ছে না কাকা। অনেক ঝামেলা।’’ নেতা-সঙ্গী পাল্টা বলেন, ‘‘কত লাগবে বলো?’’ বেশ কিছুক্ষণ চলে দর কষাকষি। শেষে ‘ডিজিটাল সেন্টার’-এর মালিক সাদা কাগজে ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বললেন, ‘‘রাতে ফোনকরবেন, জানাব।’’

ওই সাক্ষাতের তিন দিনের মধ্যে আত্মীয়ের বাড়িতে বসেই ‘কাস্টমার’ যুবক হাতে পেয়েছিলেন ঝকঝকে ভোটার ও আধার কার্ড। আট হাজার টাকা লেগেছিল তাঁর। তার পর থেকে তিনি ওই এলাকায় নেই। স্থানীয়দের দাবি, কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে গিয়েছেন। ফিরবেন বছর খানেক পরে।

নামে ‘ফটোকপি সেন্টার’, ‘কম্পিউটার সেন্টার’ বা ‘সাইবার ক্যাফে’। কিন্তু উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, মালদহ থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া বা দুই ২৪ পরগনায় সীমান্তবর্তী এলাকায় আপাতনিরীহ এমন কিছু দোকানের একাংশে চলে এই জাল কার্ডের কারবার।

উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা সীমান্ত লাগোয়া ‘সাইবার ক্যাফে’টি যেমন। চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে আসা যুবককে যেখানে নিয়ে গিয়েছিল জাল-কার্ড কারবারের ‘আড়কাঠি’ (দালাল)। যুবককে বলেছিল, আসল ভোটার কার্ড, আধার কার্ড নিতে হলে খরচ চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি। জাল কার্ড হলে খরচ ১৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশি যুবক নকল ভোটার কার্ড চান। সাইবার ক্যাফে-তে তাঁর ছবি তুলে, ভিন‌্ রাজ্যের এক জনের ভোটার কার্ডের নম্বর, বাবার নাম, ঠিকানা এক রেখে জাল কার্ড তৈরি করা হয়রঙিন প্রিন্টারে।

‘আসল’ আর নকল কার্ডের তফাত কোথায়? প্রথম ক্ষেত্রে, ভিন‌্ রাজ্যের বাসিন্দার বৈধ তথ্য দিয়ে সরকারি পোর্টালে একটি প্রোফাইল তৈরি করা হয়। তার পরে সে প্রোফাইলে তথ্য সংশোধনের জন্য ভরা হয় ফর্ম। সেই ফর্মের সঙ্গে এ দেশের বাসিন্দা হিসেবে ভিন্‌ দেশির নামেই জোগাড় করা শংসাপত্র দিয়ে নতুন করে আবেদনের পর্ব। সে তথ্য জাল বলে ধরা কঠিন। নজরদারির অভাবে এই উপায়েই ভিন‌্ দেশির ‘আসল’ আধার কার্ডহয়ে যাচ্ছে।

আর নকল কার্ডের ক্ষেত্রে সাইবার ক্যাফে-তে ছবি তুলে, ভিন‌্ রাজ্যের বা এই রাজ্যের অন্য এলাকার বাসিন্দা (যিনি এলাকায় থাকেন না বা মৃত অথচ তাঁর কার্ড সরকারি দফতরে জমা পড়েনি) এমন এক জনের ভোটার কার্ডের নম্বর (এপিক বা ইপিআইসি) বা আধার কার্ডের নম্বর, বাবার নাম, ঠিকানা এক রেখে জাল কার্ড বানানো হয় রঙিন প্রিন্টারে। ছবি সংশোধনের সফ‌্টওয়্যার ব্যবহার করে ভিন‌্‌-দেশির ছবি বসিয়ে বসানো হয় সেখানে। যেমন হয়েছিল বাগদায় বাংলাদেশি যুবকের ক্ষেত্রে।

আবার সাইবার ক্যাফের মালিক বাড়িতে বসে জাল আধার কার্ড তৈরি করছে, তেমন উদাহরণ রয়েছে নদিয়ার ধুবুলিয়ায়। ধরা পড়ার আগে সে যুবক অন্য কারও চোখের ছবি ‘স্ক্যান’ করে সরকারি পোর্টালে ঢুকে জাল নথি দিয়ে আধার কার্ড বানাচ্ছিল,অভিযোগ তেমনই।

অবশ্য এত কিছু করেও ধরা পড়েছিল বাংলাদেশের যশোরের বাসিন্দা বাসু ঘরামি। উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার পুরদহ গ্রামের বাসিন্দা গণেশ ঘরামি কর্মসূত্রে ভিন‌্-রাজ্যে থাকেন। পঞ্চায়েত ভোটের সময় বাড়ি ফিরে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন, ভোটার-তালিকায় নাম তাঁর। ছবি অন্যের। খোঁজ নিয়ে গণেশ জানতে পারেন, বাসুর ছবি সেটা। গণেশের অভিযোগের ভিত্তিতে বাসুকে ধরে পুলিশ। তবে গণেশ ভোট দিতে পারেননি। তার আগেই বাসুর ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।

গত তিন বছরে কেরল, অসম এবং তামিলনাড়ু পুলিশ এবং জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনকে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি নাগরিকের কথা জানিয়েছে, যাদের ‘ভারতীয়’ পাসপোর্ট, আধার কার্ডে ঠিকানা মুর্শিদাবাদের। (চলবে)

তথ্য অনুসন্ধানে: নমিতেশ ঘোষ, সীমান্ত মৈত্র, সুস্মিত হালদার, সামসুদ্দিন বিশ্বাস, সুজাউদ্দিন বিশ্বাস, অভিজিৎ সাহা, সমরেশ মণ্ডল

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Voter Card Bangladeshis India-Bangladesh Border Fake Voter Card

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy