Advertisement
E-Paper

বিচ্ছেদের কাগজ হাতে পেয়ে পরস্পরকে বলেছিলেন, ‘ভাল থেকো’

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেছিলেন আর আমার শ্বশুরমশাই রুপোলি বিচ্ছেদ প্রবর্তন করলেন! গেল বছর বাঙালির মুখে মুখে ফিরেছিল সুপারহিট ছবি ‘বেলাশেষে’র এই সংলাপ।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩৭
গ্রাফিক্স ‘বেলাশেষে’ ছবির দৃশ্য অবলম্বনে।

গ্রাফিক্স ‘বেলাশেষে’ ছবির দৃশ্য অবলম্বনে।

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেছিলেন আর আমার শ্বশুরমশাই রুপোলি বিচ্ছেদ প্রবর্তন করলেন!

গেল বছর বাঙালির মুখে মুখে ফিরেছিল সুপারহিট ছবি ‘বেলাশেষে’র এই সংলাপ। বাস্তবে কিন্তু ‘বেলাশেষে’-র বিশ্বনাথ মজুমদার একা নন। বরং জীবনসায়াহ্নে এসে বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়ার প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। ছবির মতো পুনর্মিলন নয়, বিচ্ছেদ মানে সেখানে বিচ্ছেদই।

গত বছরেরই কথা। যাদবপুরের বাসিন্দা ৬৭ বছরের এক প্রবীণ ৬২ বছরের স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ৪২ বছরের দাম্পত্য কাটিয়ে দেওয়া দু’টি মানুষ। দু’জনকেই কাউন্সেলিংয়ের জন্য আনা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ লিগাল এড সার্ভিসের দফতরে। কিন্তু নিরস্ত করা যায়নি। যেমন নিরস্ত হননি বেহালার শীলপাড়ার বাসিন্দা ৬৯ বছরের প্রবীণ এবং ৬৪ বছরের প্রবীণা। ডিভোর্সের মামলা দায়েরের পর দু’জনে আলাদা রয়েছেন।

ষাটোর্ধ্বদের বিচ্ছেদের পথে হাঁটার ঘটনা বা ‘সিলভার সেপারেশন’ হয়তো এখনও সংখ্যায় কম। কিন্তু লিগাল এড-এর কর্মকর্তা, আইনজীবী এবং ম্যারেজ কাউন্সেলরদের দাবি, পাঁচ-ছ’ বছর আগেও কলকাতায় এটুকুও ভাবা যেত না। কিন্তু ধীরে ধীরে আড় ভাঙছে। কখনও পরিস্থিতির চাপে, কখনও সিদ্ধান্তহীনতায়, কখনও আর্থিক কারণে বা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জীবনের মধ্যবেলায় যাঁরা হয়তো বাঁধন কাটতে পারেননি। কিন্তু জীবনের উপান্তে মুক্তির চাহিদায় তাঁরা আপসহীন।

কলকাতা হাইকোর্টের পাশে কিরণশঙ্কর রায় রোডে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত রাজ্য লিগাল এড সার্ভিসের দফতরে ‘রিলেশনশিপ কাউন্সেলিং’ হয়। এড-এর এগজিকিউটিভ চেয়ারম্যান গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছিলেন, যাদবপুরের দম্পতিকে কাউন্সেলিংয়ে ডাকা হয়েছিল। তখন জানা যায়, স্ত্রীর অত্যধিক সন্দেহ বাতিকের জন্য সারা জীবনই বিধ্বস্ত ছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু দুই মেয়ের কথা ভেবে বিচ্ছেদের পথে যেতে পারেননি। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে তিনি মুক্তি চাইছেন। মেয়েরাও বাবা-র পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রবীণের বক্তব্য, ‘‘এত দিন একটা দায় ছিল। এখন আর জোড়াতাপ্পির জীবন কাটাতে চাই না। স্ত্রীর আর্থিক সংস্থান করে রেখেছি।’’ ২০১৫-তেই বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন শীলপাড়ার দম্পতিও। লিগাল এডের প্রধান কাউন্সেলর মালবিকা দাস জানালেন, ওই দম্পতির মধ্যে ঝামেলা লেগেই থাকত। তার পরেও একসঙ্গে থেকে গিয়েছেন ছেলের জন্য। সেই ছেলে এখন বিয়ে করে আমেরিকায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ডিভোর্সের মামলা শুরু হয়েছে। খরচ দিচ্ছেন ছেলে।

সময়ের গতিতে সামাজিক কাঠামো এবং পরিষেবায় বহু পরিবর্তন এসেছে। সেগুলোই প্রবীণদের সাহস জোগাচ্ছে। জেরেন্টোলজিস্ট বা বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী লক্ষ্য করেছেন, আজকাল ছেলেমেয়েরাও এ সব ক্ষেত্রে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সেই সঙ্গে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একা থাকায় সাহায্য করার মতো নানা পরিষেবাও টাকা দিলেই মিলছে। ডাক্তার দেখানো, ওষুধ বাড়িতে দিয়ে যাওয়া, খাবার এনে দেওয়া, আয়া-রেশন-মাসকাবারি জিনিস কেনা, এমনকী গল্প করা বা বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার লোকও এখন টাকা দিলে মেলে। ভাল বৃদ্ধাবাসের সংখ্যাও বেড়েছে। যাঁরা বিবাহিত জীবনে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছেন তাঁরা এ সবের সাহায্য অন্তত শেষ জীবনটা ভাল কাটাতে চাইছেন।

লিগাল এডের কাছেই এসেছিলেন ডানকুনির বাসিন্দা একষট্টি বছরের এক মহিলা। বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করেছেন বিয়ের চল্লিশ বছর পর। একমাত্র মেয়ে ভাল চাকরি করেন আমেরিকায়। তিনিই মা’র সব খরচ দেন। ওই মহিলার বক্তব্য, ‘‘বিয়ের পর থেকেই স্বামী অত্যাচার করত। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে পড়ে শুধু মার খেয়েছি।’’ একই রকম ভাবে ইন্দ্রাণীর কাছেও দিন কয়েক আগে বাঘাযতীন থেকে বছর চৌষট্টির এক মহিলা এসেছিলেন। তিনিও বিয়াল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়ে ডিভোর্সের মামলা করেছেন। তাঁরও বক্তব্য, সারা জীবন স্বামীর দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন। এ বার সম্মানের জীবন চান।

জীবন সায়াহ্নে নিজের শর্তে বাঁচার এই আকাঙ্খাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন অনেকেই। পর্দার ‘বেলাশেষে’ মিলনান্ত হলেও পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিজের মত, ‘‘যে সব ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের পক্ষে জোরালো এবং যথার্থ কারণ থাকে সেখানে দেরিতে হলেও বিচ্ছেদের পথে হাঁটা উচিত।’’ সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনও বললেন, ‘‘আমি তো সব সময় মনে করি, একটা বোকা বা রাগী বর হওয়ার থেকে একা থাকা অনেক ভাল। অল্প বয়সে হয়তো এঁরা আত্মবিশ্বাস জোটাতে পারেননি। এখন সাহস করেছেন, সেটা ভালই তো!’’ নিজের উদাহরণও দিলেন নবনীতা। বললেন, ‘‘আমার বিখ্যাত বর সঙ্গে থাকেননি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক তো আছে। কাছে থাকলে হয়তো দু’জনেই দাঁত কিড়মিড় করতাম।’’

ব্যারাকপুর থেকে এক দম্পতি এসেছিলেন লিগাল এডের ডিরেক্টর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। দু’জনেই শিক্ষিত, ভাল চাকরি করেছেন। সাতচল্লিশ বছরের দাম্পত্যের পর তাঁরা মিউচুয়াল ডিভোর্স চেয়েছিলেন। কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন, তাঁদের দু’জনের জগৎ আলাদা। কেউ কারও কাছ থেকে কোনও টাকাকড়ি, সম্পত্তি দাবি করেননি। বিচ্ছেদের কাগজ হাতে পেয়ে পরস্পরকে বলে গিয়েছিলেন, ‘‘ভাল থেকো।’’

Divorce rate Elderly couple
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy