রাজ্যের অন্যতম শিল্পের মুখ রঘুনাথপুর। রাজ্য সরকার এমনটা দাবি করে এলেও গত কয়েক বছরে রঘুনাথপুরে বড় কোনও শিল্প আসেনি। বামফ্রন্ট সরকারও ডিভিসি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া ভারী কোনও শিল্পও আনতে পারেনি।
বাস্তবে রঘুনাথপুরের শিল্পের চেহারা এমনটা হলেও জেলা-সহ পাশ্ববর্তী এলাকার তরুণ প্রজন্ম কিন্তু কারিগরির শিক্ষার দিকেই ঝুঁকেছে। পুরুলিয়া জেলার অন্যতম শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (আইটিআই) রঘুনাথপুরে এ বার ভর্তি হতে চেয়ে রের্কড সংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে। তা দেখেই এলাকার তরুণদের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে বলেই মনে করছেন কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট মহল।
আইটিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার জন্য ফর্ম পূরণ করেছেন ৮,২৫৮ জন ছাত্রছাত্রী। যা কার্যত রেকর্ড বলেই মানছেন ওই শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষকরা। ২০১২ সালের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৬০০০-র কিছু বেশি। কিন্তু ৪৫০টি আসনের জন্য এই বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ভর্তির আবেদনের প্রেক্ষিতেই উঠে আসছে চাহিদা বাড়া স্বত্ত্বেও জেলার অন্যান্য আইটিআইগুলির এখনও চালু না করার অভিযোগ। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, বছর তিনেক আগেই পুরুলিয়ায় আরও ছ’টি আইটিআই তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য কারিগরি শিক্ষা দফতর। তার মধ্যে এখনও একটিতেও পঠনপাঠন শুরু করা যায়নি। নির্মাণ কাজ চলছে বলরামপুর, সাঁতুড়ি, মানবাজার ও হুড়া ব্লকের আইটিআিই কেন্দ্রগুলির। কিন্তু কাশীপুর ও রঘুনাথপুর ২ ব্লকের কেন্দ্রগুলির নির্মাণ কাজও শুরু হয়নি। রঘুনাথপুরই এতদিন জেলার একমাত্র আইটিআই কেন্দ্র ছিল। বছর খানেক হল ঝালদায় একটি ছোটমাপের আইটিআই কেন্দ্র চালু হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে রাজ্যের কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী উজ্জল বিশ্বাস বলেন, ‘‘রাজ্যে ৮০টি নতুন আইটিআই শুরুর মুখে। পিপিপি মডেলের এই আইটিআইগুলিতে ভবন-সহ অন্যান্য পরিকাঠামো গড়ে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। পঠনপাঠনের দায়িত্ব নেবে বিভিন্ন সংস্থা।’’ এই আইটিআইগুলিতে রাজ্যের নির্ধারিত কোর্স ফি দিয়েই ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতে পারবেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। তাঁরও আশ্বাস, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই আইটিআইগুলিতে পঠনপাঠন শুরু হয়ে যাবে।
বস্তুত কারিগরি শিক্ষা দফতরের দূর্গাপুর অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম আইটিআই হিসাবে রঘুনাথপুরের গুরুত্ব বাড়ছে। পুরুলিয়ার পাশাপাশি বাঁকুড়া ও আসানসোলের একাংশ থেকেও রঘুনাথপুরে ভর্তি হতে চাইছেন ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু এ বছর ভর্তির আবেদনপত্র পূরণের সংখ্যা দেখে কার্যত চোখ কপালে উঠেছে আইটিআই কর্তৃপক্ষর।
সূত্রের খবর, গত বছর ভর্তির জন্য আবেদন জানিয়েছিলে কমবেশি ৪০০০ ছাত্রছাত্রী। ২০১৩ সালে সংখ্যাটা ছিল ৩০০০ –এর মতো। তার আগের বছর কমবেশি ২৫০০ আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। গত বছরের তুলনায় ৪০০০-এর বেশি আবেদন জমা পড়ায় সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে গোটা জেলা জুড়েই কারিগরি শিক্ষা ক্ষেত্রে ভর্তি হতে আগ্রহ বাড়ছে। আর তাতেই জেলার মধ্যে অন্যতম এই আইটিআই-এ চাপও বাড়ছে। কারিগরি শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দূর্গাপুর অঞ্চলের মধ্যে থাকা পাঁচ জেলা বর্ধমান, দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় সরকারি আইটিআইয়ের সংখ্যা ১৩টি। তার মধ্যে দূর্গাপুর ও রঘুনাথপুরে ভর্তির জন্য প্রায় সমান সংখ্যক ফর্ম জমা পড়েছে। অনেক পিছনে রয়েছে বাকি আইটিআইগুলি.
রঘুনাথপুরের চাহিদা ও গুরুত্ব বাড়ার পিছনে এই আইটিআই-এর পরিকাঠামো ও এখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় চাকরি পাওয়ার সুযোগ ক্রমশ বাড়ছে বলে মত আইটিআই কর্তৃপক্ষের। রঘুনাথপুরের শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উন্নয়নে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন তহবিল থেকে পাওয়া টাকায় কাজ চলছে। কয়েক কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য করেছে রঘুনাথপুরের ডিভিসি বিদ্যুৎকেন্দ্র। সব মিলিয়ে কয়েক বছরে ভোল বদলে আধুনীক ও ঝাঁ চকচকে হয়ে উঠেছে রঘুনাথপুরের শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। সেই সঙ্গে গত কয়েক বছরে এখানে ক্যাম্পাসিং-এর সুযোগও অনেকটাই বেড়েছে।
রঘুনাথপুরের.আইটিআই সূত্রের খবর, গত তিন-চার বছরে ভিন্ রাজ্য-সহ এ রাজ্যের ছোট ও মাঝারি মাপের শিল্প সংস্থাগুলি ক্যাম্পাসিং করতে আসছে রঘুনাথপুরে। তবে ভিন্ রাজ্যের সংস্থার সংখ্যাই তুলনামূলক বেশি। আইটিআই কর্তৃপক্ষের দাবি, ক্যাম্পাসিংয়ে গড়ে তাদেরে ৬০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই চাকরি পাচ্ছেন। তবে ঘটনা হল পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো জেলার ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ রাজ্যে চাকরি করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা থাকায় শেষে তাঁরা অনেকেই কাজে যোগ দিতে যাচ্ছেন না। এ ছাড়া সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও আইটিআই এর পড়ুয়ারা উল্লেখযোগ্য হারে সাফল্য পাচ্ছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কিছু শিক্ষকের কথায়, ‘‘পরিকাঠামো এবং ক্যাম্পাসিং এর সুযোগ বৃদ্ধি— দুই এর কারণে রঘুনাথপুর আইটিআই-এর চাহিদা বাড়ছে পুরুলিয়া-সহ বাঁকুড়া, বর্ধমানের মতো জেলার ছাত্রছাত্রীদের কাছে।”
আর এই প্রেক্ষিতেই উঠে এসেছে জেলার অন্যান্য আইটিআইগুলি শুরু না করার অভিযোগ। ডিএসও-র জেলা সভাপতি স্বদেশপ্রিয় মাহাতো ও এবিভিপি-র রাজ্য নেতা সুরজিৎ লাই দু’জনেই বলেন, ‘‘জেলা সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী পুরুলিয়ার সমস্ত ব্লকে আইটিআই তৈরির ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে ২০টি ব্লকের মধ্যে একটি আইটিআই শুরুই হয়নি। ফলে চাপ বাড়ছে রঘুনাথপুরের উপরে।” অন্যদিকে, যে কেন্দ্রের এত চাহিদা, সেই রঘুনাথপুর শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষক ও কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, শিক্ষক ও কর্মীর ৪০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। এই উত্তুঙ্গ চাহিদা দেখে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই সাঁতুড়িতে আইটিআই ও নিতুড়িয়ায় পলিটেকনিক কলেজ শুরুর আশ্বাস দিয়েছেন রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy