দমদম সেন্ট্রাল জেলে নাটকের মহড়া। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সংলাপটা বলতে গিয়ে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছেন বুলু।
নাটকে আছে, তাঁকে বলতে হবে, ‘‘ছোটবেলায় আমারও একটা ডানাভাঙা বক ছিল!’’
সত্যিই ছিল যে! ‘‘ভাই গুলতি দিয়ে মেরেছিল বকটাকে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এসে পড়েছিল দাওয়ার সামনে। ওকে তুলে নিয়ে ডানায় হলুদবাটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। বেঁচে গিয়েছিল।’’
ডানা-ভাঙা বককে আগলে রাখা বুলুই পরে একদিন খুনের আসামি। যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে সাড়ে তেরো বছর ধরে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বন্দি।
জেলের চৌহদ্দির মধ্যে বছর তেতাল্লিশের বুলুরানি কিন্তু এখনও বড় ‘ভালমানুষ’। গত তেরো বছরে বন্দি শিশুদের নিয়ে তিল তিল করে বুলু গড়ে তুলেছেন একটা আস্ত স্কুল। উচ্চমাধ্যমিক পাশ ‘বুলু দিদিমণি’র স্কুলে এখন পড়ুয়ার সংখ্যা আশির কোঠায়। তবু চার দেওয়ালের মধ্যে সময় কাটে না বুলুর। বারবার জেলের ডিআইজি সুদীপ্ত চক্রবর্তী এবং সুপার নবীন সাহাকে বলতেন, ‘‘আমাকে আলিপুরে বদলি করে দিন। ওখানে নাটক হয়। আমি নাটক করব।’’ সুদীপ্ত-নবীনবাবুরা প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে বলতেন, ‘‘এখানেই আমরা নাটক নিয়ে আসছি। সেখানে অভিনয় করবে।’’
আশ্বাস মিথ্যে হয়নি। দমদম জেলেও নাটক এসেছে। নান্দীকারের পরিচালনায় ‘ভালমানুষ’ নাটকের তালিমে মুখ্য চরিত্র জানকী আর জনার্দন সাজছেন বুলু-ই।
বুলুর ‘জানকী’ হয়ে ওঠার পিছনেও একটা নাটক আছে। ‘‘প্রথম কয়েক দিন সবাই পার্ট বলত। আমি চুপ করে বসে থাকতাম। এক দিন দেখি, সোহিনীদি ( সোহিনী সেনগুপ্ত) বলছেন, জানকীর চরিত্রে এখানে তেমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। উনিই চরিত্রটা অভিনয় করবেন। তখন বললাম, আমাকে দেবেন? আমি একবার চেষ্টা করে দেখব?’’
পরের অংশটা বললেন নান্দীকারেরই সপ্তর্ষি মৌলিক, ‘‘রাত জেগে পার্ট মুখস্থ করে দু’দিন পরে রিহার্সালে এসেছিলেন বুলু। আমাদের পছন্দ হয়ে গেল।’’
এ রাজ্যের সংশোধনাগারের ইতিহাসে বন্দিদের নিয়ে নাটক করার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু তার বেশির ভাগই রত্নাকর থেকে বাল্মীকি কিংবা চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হয়ে ওঠার কাহিনি। ব্রেটোল্ড ব্রেশট-এর ‘দ্য গুড পার্সন অব সেজুয়ান’-এর বাংলা অনুবাদ ‘ভালমানুষ’ কিন্তু এক উলটপুরাণ। এখানে কেউ খারাপ থেকে ভাল হয় না। বরং ভালকে কী ভাবে সমাজই খারাপ বানিয়ে তোলে, এ তার গল্প। সেই গল্পের পরতে পরতে নিজেদের এখন মিলিয়ে নিচ্ছেন বুলু, গুঞ্জন কিংবা সিরাজুলরা। ওয়র্কশপে তাই চোর-পুলিশের অভিনয়ে কেউ ‘চোর’ হতে চাইতেন না। ‘‘চোর কেন চোর হল, সেটা তো বলতে হবে,’’ এটাই ওঁদের দাবি। ‘ভালমানুষ’ সেই দাবিই মিটিয়ে দিচ্ছে যেন!
নান্দীকারের ইতিহাসেও ‘ভালমানুষ’ একটা বড় মাইলফলক, বলছিলেন সোহিনী। তাঁর কথায়, ‘‘সত্তরের দশকে এই নাটকে মু্খ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন কেয়া চক্রবর্তী। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই নাটকে ফের অভিনীত হয় ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’ নাম দিয়ে। সেখানে মু্খ্য চরিত্রে আমার মা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।’’ এ বারে দমদম জেলের ২৩ জন বন্দিকে (এর মধ্যে ১৪ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত) নিয়ে আগামী ২০ অগস্ট অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে যে নাটক প্রথমবার মঞ্চস্থ হতে চলেছে, তার মধ্যে ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’র ছায়াই বেশি। নামটা অবশ্য ‘ভালমানুষ’ই। তবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রয়োজনে নাটকের অনেক কিছুই খানিকটা সরল করতে হয়েছে। বদলাতে হয়েছে জানকীর জীবিকাও। ‘ভালমানুষ’কে বেছে নেওয়ার পিছনে আরও কারণ রয়েছে। সোহিনীর কথায়, ‘‘ব্রেশটের নাটক অনেক বেশি প্রাচ্য শৈলীর। যেটা আমাদের কথকতার সঙ্গে মেলে। আমার মনে হয়েছে ওঁরা এই নাটকটায় সহজে একাত্ম হতে পারবেন।’’
বন্দিরা যাতে একাত্ম হতে পারেন, সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন কারা দফতরের এডিজি অধীর শর্মা-ও। তিনি বলেন, ‘‘দমদম জেলে নাটক নিয়ে বন্দিদের মধ্যে তেমন বড় কাজ হয়নি। সেই কারণে, নান্দীকারকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম।’’
২৪ জন বন্দির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে নান্দীকারের সম্রাট বসু, অর্ঘ্য দে সরকার, অয়ন ঘোষদের। এখন ওঁদের হাত ধরেই মহড়ায় মশগুল রতন, বাপ্পা, গিরিধারীরা। দমদম জেলের সংস্কৃতি চর্চার মঞ্চে তাঁদের রিহার্সাল দেখতে বাইরেও বন্দিদের ভিড় জমে যায়। জেলে পাইপ কেটে বাঁশি বাজাতেন জীবনকৃষ্ণ। নান্দীকার আসার পরে তাঁর হাতে এসেছে ‘আসল’ বাঁশি। আর বাপ্পার কথায়, ‘‘ভালমানুষের সঙ্গে কী রকম হয়, সেটা তো আমরা জানতাম। নাটকটার সঙ্গে তাই যেন নিজেকেই জড়িয়ে ফেলেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy