Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

যন্ত্র আছে যন্ত্রী নেই, গবেষণা থমকে বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজে

যন্ত্র আছে, যন্ত্রী নেই। আর তাতেই গবেষণার কাজে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষক ও গবেষকরা।

মাস স্পেকট্রোমিটার।

মাস স্পেকট্রোমিটার।

সৌভিক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ১৩:২৪
Share: Save:

যন্ত্র আছে, যন্ত্রী নেই। আর তাতেই গবেষণার কাজে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষক ও গবেষকরা।

রক্তের মধ্যে ঠিক কোন প্রোটিনের অভাবে রোগটা হয় তা প্রায় ধরে ফেলেছেন বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজের এক গবেষক। এবার যন্ত্রের সাহায্যে প্রোটিনের মিশ্রণ থেকে ওই বিশেষ প্রোটিনকে আলাদা করতে পারলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু যন্ত্রটি ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি অবাক। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় নাকি চলে গিয়েছেন ‘টেকনিশিয়ান’। যন্ত্রীর অভাবে মাস তিনেক ধরে এভাবেই পড়ে রয়েছে বহু মূল্যবান যন্ত্রটি।

শুধু এই যন্ত্রটিই নয়, একই দশা আরও কয়েকটি বহুমূল্যবান যন্ত্রের। আর দীর্ঘ দিন অব্যবহারের ফলে যন্ত্রগুলিও নষ্ট হওয়ার মুখে। থমকে গিয়েছে জীববিদ্যার বিভিন্ন গবেষণার কাজও। এমনটাই অভিযোগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগ পরিচালিত আইপিএলএস (ইন্টার ডিসিপ্লিনারি প্রোগ্রাম ইন লাইফ সায়েন্স) প্রকল্পের বিরুদ্ধে।


কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ। বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজ।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, বছর পাঁচেক আগে আইপিএলএস প্রকল্পে ১৫ কোটি টাকা পায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই টাকা দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই কিনে ফেলা হয় ‘মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি’, ‘অ্যাটমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ’, ‘কনফোকাল লেসার স্ক্যানিং মাইক্রোস্কোপ’-এর মতো কয়েকটি বহু মূল্যবান যন্ত্র। প্রত্যেকটিরই দাম কোটি টাকার উপরে। গবেষণার ক্ষেত্রেও এই যন্ত্রগুলির ভূমিকা অপরিহার্য। টেকনিশিয়ান চলে যাওয়ায় যন্ত্রগুলি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

কিন্তু টেকনিশিয়ান চলে গেলেও কেন নেওয়া হচ্ছে না নতুন লোক?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, প্রথম থেকে যাঁরা এই যন্ত্রগুলি চালাতেন তাঁরা কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী নন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টেকনিশিয়ান’ পদটিই নেই। যে সংস্থার থেকে যন্ত্রগুলি কেনা হয়েছিল তারাই তিন বছরের চুক্তিতে টেকনিশিয়ান দিয়েছিল। প্রথম তিন বছর তাই যন্ত্রগুলি চালাতে কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু মেয়াদ ফুরোতেই টেকনিশিয়ানরা চলে গিয়েছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকনিশিয়ান পদটিরই কোনও অস্তিত্ব না থাকায় নতুন লোক নেওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে যন্ত্রগুলির ভবিষ্যত এখন বিশ বাঁও জলে। এক শিক্ষক বলেন, ‘‘এত টাকা খরচ করে যন্ত্র কেনা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো কী ভাবে চলবে তখন ভাবা হয়নি। তাছাড়া এই যন্ত্রগুলো এতই উচ্চ মানের যে যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া এগুলো চালানো সম্ভব নয়।’’


কলকাতায় বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজ।

তাহলে কী থেমে থাকবে গবেষণার কাজ?

আইপিএলএসের আহ্বায়ক বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রধান মৈত্রেয়ী দাশগুপ্ত জানান, চুক্তির ভিত্তিতে টেকনিশিয়ান নেওয়া হলেও পরে তাঁরা ভাল বেতন পেয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। সে কারণেই দেখা দিচ্ছে সমস্যা। শুধু আইপিএলএস প্রকল্পই নয়, যথাযথ টেকনিশিয়ানের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু যন্ত্রই বেহাল। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ধরণের সমস্যা রয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন টেন্ডার ডেকে এই মূল্যবান যন্ত্রগুলি বিশেষ কোনও সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই সংস্থাই দেখভাল করে যন্ত্রটির। তিনি বলেন, ‘‘এখানেও সে রকম কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এতে যন্ত্রগুলি ভাল থাকে এবং শিক্ষক, গবেষকরা বিনা বাধায় কাজ করতে পারেন।’’

তিনি আরও জানান, বিষয়টি উপাচার্যের কাছেও জানানো হয়েছে। লোক চাওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘গত ছ’ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। পুরনো যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা সকলেই অন্যত্র চলে গিয়েছেন। নতুন যাঁরা এসেছেন তাঁদের তো কিছুটা সময় দিতেই হবে।’’

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছেই। তিন বছর ধরে যন্ত্রগুলিতে কাজ করা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বা গবেষকরা কেন চালাতে শিখলেন না এগুলি?

মৈত্রেয়ী দেবী বলেন, ‘‘প্রশিক্ষিত লোক ছাড়া অন্য কারো হাতে যন্ত্র ছাড়ার প্রশ্নই নেই। আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, পড়ুয়া কোনও দায়িত্ব নিতে চায় না। ওদের কাজটুকু হলেই হল। ওদের হাতে যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়।’’

মৈত্রেয়ী দেবীর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ। তাঁরা জানান, যে কোনও যন্ত্রই চালানোর জন্য সেই যন্ত্রের সঙ্গে সখ্যতার দরকার পড়ে। যন্ত্রকে ভালবাসতে হয়, বুঝতে হয়। তবেই একাত্ম হতে পারে যন্ত্র ও যন্ত্রী। তাঁদের কথায়, ‘‘পৃথিবীর সব দেশেই পড়ুয়াদের এই ধরনের যন্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখানেই শুধু অন্য নিয়ম। ছেলেমেয়েদের হাতে চাড়লে ওরা কাজ শিখত, চাকরি পেতেও অনেক সুবিধে হত। আর সবচেয়ে বড় কথা, টেকনিশিয়ানের অভাবে কাজ আটকে থাকত না।’’

কিন্তু কলকাতার মত বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকনিশিয়ানের মত এত গুরুত্বপূর্ণ পদ নেই কেন?

উপাচার্য সুগত মারজিত বলেন, ‘‘বিস্ববিদ্যালয়ে এখনও অনেক পদ রয়েছে, যে গুলির দরকার নেই। আবার অনেক প্রয়োজনীয় পদ নেই। আমি বিষয়টি শুনেছি। আমরা সবাই চেষ্টা করছি যাতে দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়। গবেষণা আটকে থাকবে এটা কখনই কাম্য নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

research ballygunge college science calcutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE