তখনও যুদ্ধে ছিলেন। অসীমের পাশে রবীন (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
বিধানসভা ভোটের আগে বাইরে ঘুঁটি সাজানোর পালায় সিলমোহর দিল আলিমুদ্দিন। অথচ সেই সময়েই বিধাননগর পুরভোটকে ঘিরে ঘরের সমস্যা বেআব্রু হয়ে গেল সিপিএমে!
শাসক দলের ভোট লুঠের চেষ্টা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে পতাকা ছেড়ে বিভিন্ন দলের নেতা এবং এলাকার বিশিষ্ট জনেদের একজোট করে ‘সল্টলেক সিটিজেন্স ফোরাম’ গড়ে তুলেছেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। নাগরিক মঞ্চ গড়ে এ ভাবে দলমত নির্বিশেষে শাসক দলের আক্রমণ মোকাবিলার চেষ্টার মডেলকে বৃহস্পতিবার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে। কিন্তু বাইরের লোকজনকে এককাট্টা করার এই প্রয়াস নিয়ে যখন চর্চা চলছে, সেই দিনই বিধাননগর পুরসভার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন রাজারহাটের প্রাক্তন বিধায়ক রবীন মণ্ডল! দলের এক জন ওজনদার নেতা ভোটের লড়াই থেকে এ ভাবে সরে দাঁড়ানোয় প্রত্যাশিত ভাবেই বামেদের কটাক্ষ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে তৃণমূল। এবং রবীন-কাণ্ডে দলের অন্দরে কাঠগড়ায় উঠতে হচ্ছে সেই গৌতমবাবুকেই!
সল্টলেকের দলীয় কার্যালয়ে রবীনবাবুকে পাশে বসিয়েই রবিবার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছিলেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক। বলেছিলেন, তাঁরা এই পুরভোট লড়ছেন রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের নেতৃত্বে। তাঁকে সহযোগিতা করবেন রবীনবাবু এবং প্রয়াত প্রাক্তন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর স্ত্রী রমলা চক্রবর্তী। সে দিন প্রার্থী তালিকায় রবীনবাবুর নাম ছিল রাজারহাট এলাকার ২০ নম্বর ওয়ার্ডে। তার দু’দিন পরেই রবীনবাবু কিন্তু মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। সেই ওয়ার্ডে আবার বুধবারই মনোনয়ন জমা দেন আগের ঘোষিত প্রার্থী শৌভিক প্রামাণিক। তখনই জটিলতার ইঙ্গিত স্পষ্ট ছিল। শেষ পর্যন্ত এ দিন রবীনবাবু ভোটে না লড়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে দলের বিড়ম্বনা সম্পূর্ণ করেছেন!
অস্বস্তি সামাল দিতে সিপিএম নেতৃত্বকে এখন ‘সংগঠক’ রবীনবাবুকে সামনে আনতে হচ্ছে! জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু যেমন বলেছেন, ‘‘প্রথমে ঠিক হয়েছিল, লড়বে। এখন ঠিক হয়েছে, লড়বে না। এতে রণে ভঙ্গ দেওয়ার কী আছে?’’ রবীনবাবুর কি ওয়ার্ড পছন্দ হচ্ছিল না? গৌতমবাবুর জবাব, ‘‘ওয়ার্ড তো বেছে দেব আমরা! রবীন মণ্ডল রাজারহাটের ২৭টা ওয়ার্ডেই (বিধাননগর পুরসভার ৪১টির মধ্যে ২৭টি ওয়ার্ড রাজারহাট-নিউটাউন এলাকায়) লড়বে!’’ এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকেও বলতে হয়েছে, ‘‘প্রথমে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, সংগঠক হিসাবে ওঁকে কাজে লাগানোই বেশি জরুরি। উনিও সেই দায়িত্ব মেনে নিয়েছেন।’’
কী বলছেন স্বয়ং রবীনবাবু? তাঁর বক্তব্য, তিনি প্রথম থেকেই বিধাননগর পুরভোটে লড়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু দলের চাপে তিনি রাজি হয়েছিলেন। রবীনবাবুর কথায়, ‘‘এত বড় নির্বাচনে কোনও এক জন বিশিষ্ট নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল। অসীমবাবুকে দল প্রার্থী হতে বলেছিল। কিন্তু উনি দলের কাছে ভাবার সময় চান। ফলত, আমি রাজি হয়েছিলাম। এ বার
অসীমবাবুকে যখন দলের মুখ হিসেবে পাওয়া গিয়েছে, তখন আমি সংগঠনের কাজ মন দিয়ে করতে চাই।’’ কিন্তু প্রশ্ন থাকছে, অসীমবাবু প্রার্থী হচ্ছেন জেনেও তিনি মনোনয়ন জমা দিতে গেলেন কেন? তাতে আরও অস্বস্তি বাড়ল! সিপিএমের একাংশের বক্তব্য, অসীমবাবু নাকি রবীনবাবু— কাকে সামনে রেখে লড়াই হবে, এই নিয়ে যখন দলের অন্দরে আলোচনা জারি আছে, সেই সময়েই টিভি চ্যানেলে হঠাৎ রবীনবাবুর নাম বলে দিয়েছিলেন গৌতমবাবু! পরে অসীমবাবুকেই সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করায় প্রবীণ রবীনবাবু বিষয়টিকে ‘অসম্মান’ হিসাবেই দেখেছেন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘ভোটে হার-জিত আছেই। জটিল ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে আসা রবীনদা হারের ভয়ে সরে গেলেন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই রকম একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেল!’’
ঘটনা হল, জেলা রাজনীতিতে রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায়ের বিরোধী বলেই পরিচিতি ছিল রবীনবাবুর। মাসকয়েক আগেই দলের নতুন জেলা সম্পাদকমণ্ডলী গঠনের সময় রবীনবাবুদের মত প্রাধান্য পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তাপস, রমলারা। তাপসবাবু তৃণমূলে চলে যাওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে রবীনবাবুকে ‘ব্যবহার’ করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল গৌতমবাবুদের সামনে। কিন্তু রণকৌশল তৈরিতে ব্যর্থতার কথাই এখন উঠে আসছে দলীয় চর্চায়। রাজারহাটে সিপিএমের একটি সূত্রের বক্তব্য, প্রথমে ৭, পরে ২০ এবং তারও পরে ২৭— যে তিনটি ওয়ার্ডে রবীনবাবুকে প্রার্থী করার পরিকল্পনা হয়েছে, প্রতিটা ওয়ার্ডেই দলের কর্মীদের একাংশের সঙ্গে সমস্যা ছিল। শেষ পর্যন্ত রবীনবাবু প্রার্থী না
হওয়ায় সেই সাংগঠনিক সমস্যা হয়তো এড়ানো গেল। কিন্তু মুখ পুড়ল দলের!
এমন ‘সুযোগ’ পেয়ে সদ্য তৃণমূলে গিয়ে প্রার্থী হওয়া তাপসবাবুর কটাক্ষ, ‘‘রবীনবাবু ভালোই করেছেন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে। আমরা যখন সিপিএমে ছিলাম, তখন ওঁর ভোট বৈতরণী আমাদের পার করতে হতো! ওঁর পিছনে কেউ নেই। তাই এই বয়সে এসে আবার ভোটে হারার আশঙ্কায় উনি সরে দাঁড়িয়েছেন!’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকেরও সংযোজন, ‘‘রবীনবাবু পালালেন! তাই ওঁকে হারানোর সুযোগটা আমরা পেলাম না!’’
ঘরে এমন সমস্যার সময়েও নাগরিক মঞ্চের প্রয়াসে অবশ্য দলের রাজ্য নেতৃত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন গৌতমবাবু। রাজ্য কমিটির জবাবি ভাষণে রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবু এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাম, কংগ্রেস, বিজেপি বা বিক্ষুব্ধ তৃণমূল— যারাই আক্রান্ত হোক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ লোকজনকে নিয়ে তার মোকাবিলা করতে হবে। পরেও সূর্যবাবু বলেন, ‘‘নাগরিক সমাজ বলতে যা বোঝায়, তাঁরা যদি দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসেন, আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাব। যেখানে যতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা নেওয়া সম্ভব, আমরা নেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy