Advertisement
E-Paper

‘গাধাপাড়া’র রোজগার কমিয়েছে ঢালাই রাস্তা

গঙ্গা পাড়ের দক্ষিণ সাঁকরাইল গ্রামে বিয়ের মরসুম হলে ভোর থেকেই গাধা এবং খচ্চরদের দম ফেলবার ফুরসত থাকে না। কারণ গ্রামের আশপাশে বিয়ে থাকলেই গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্য তাদের পিঠে সওয়ারি হন বর এবং বরের বন্ধুরা।

অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:২৯
এই ছবি আর কতদিন? ছবি: সুব্রত জানা।

এই ছবি আর কতদিন? ছবি: সুব্রত জানা।

গঙ্গা পাড়ের দক্ষিণ সাঁকরাইল গ্রামে বিয়ের মরসুম হলে ভোর থেকেই গাধা এবং খচ্চরদের দম ফেলবার ফুরসত থাকে না। কারণ গ্রামের আশপাশে বিয়ে থাকলেই গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্য তাদের পিঠে সওয়ারি হন বর এবং বরের বন্ধুরা।

সাদা-কালো কোনও ছবির গল্প নয়। হাওড়ার সাঁকরাইল ব্লকের অন্তর্গত দক্ষিণ সাঁকরাইল পঞ্চায়েত এলাকায় গাধাপাড়া নামে আস্ত একটি পাড়া রয়েছে। ‘ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া’র স্বপ্নের বাইরে এই এলাকা যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সেখানে মিলেমিশে বাস করে গাধা, খচ্চর এবং কয়েক ঘর মানুষ। বিয়ের মরসুম ছাড়া অন্য সময়ে ইট, সিমেন্ট, খড় বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানকার মানুষের অন্যতম ভরসা গাধা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এলাকা সংলগ্ন কয়েকটি ইটভাটা এবং গঙ্গায় যাওয়ার রাস্তা সরু হওয়ায় মোটরবাইক ছাড়া কিছুই ঢোকে না। কামদেবপুর, হালিশহর-সহ কয়েকটি এলাকাতেও লরি, বড় গাড়ি ঢুকতে পারে না। সেই জায়গাগুলিতেই মাল বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাধাদের ডাক পড়ে। কখনও কখনও গলির ভিতরের নোংরা, কাদা এড়ানোর জন্যও গাধার পিঠে চড়েই রাস্তা পারাপার করে এলাকার মানুষ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, খুদেরাও গাধায় চড়েন।

গঙ্গা তীরবর্তী এই গাধাপাড়ার পাশেই রয়েছে ন্যাশনাল জুটমিল। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম এই জুটমিলে কাঁচামাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্বাধীনতার আগে থেকেই এই এলাকার বাসিন্দারা গাধা পোষা শুরু করেছিল। কিন্তু বাজারে পাটের চাহিদা কমতে থাকায় নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে ন্যাশানাল জুটমিল ধুঁকতে শুরু করে। ২০০৩-০৪ সাল নাগাদ সেখানে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তার পর মিল সংলগ্ন ইটভাটায় গাধাদের ভাড়া খাটানো হয়। তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ইটভাটায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় গাধাদের রোজগার কমে গিয়েছে। গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্যও ইদানিং গাধা-খচ্চরদের তেমন ডাক আসে কই! ফলে অর্থকষ্টে ভুগছেন গাধার মালিকেরা। সরু গলির মধ্যে পাশাপাশি কয়েকটি ছোট ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনওক্রমে চলছে তাঁদের দিনযাপন।

গাধাপাড়ায় অবাঙালি পরিবারের বাস বেশি। এদের অনেকেই ন্যাশনাল জুটমিলে কাজ করতেন। পাড়ায় ঢোকার মুখে দেখা গেল এ দিক-ও দিক ঘুরে বেড়াচ্ছে দু’তিনটি গাধা। তাদের মালিকের খোঁজ করতে করতে দেখা মিলল লক্ষ্মণ প্রজাপতির। ঠাকুরদার আমল থেকে গাধা ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা তাঁদের। বর্তমানে তাঁর কয়েকটি গাধা এবং খচ্চর রয়েছে (সঠিক সংখ্যা তিনি জানাতে চাননি)। লক্ষ্মণবাবু জানালেন, দূরত্ব অনুসারে গাধার ভাড়া এখন চারশো থেকে হাজার টাকা। কয়েক বছর আগে ওই এলাকায় কয়েকটি রাস্তাকে ঢালাই করা হয়েছে। ফলে সেই রাস্তাগুলিতে গাড়ি ঢুকতে শুরু করেছে। মাল বইতে গাধার ডাক আসছে কম। রোজগার বন্ধ থাকায় মাঝে মধ্যেই এক বেলা খেয়েই গাধা এবং গাধার মালিকদের দিন কাটছে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বছর কুড়ি আগেও ওই গ্রামে প্রায় ৪০টি গাধা এবং ২০টি খচ্চর থাকত। তাদের অনেকেই মারা গিয়েছে। অনেকে গাধা বিক্রি করে দিয়েছেন। তেমনই একজন মন্টু প্রজাপতি গাধা বিক্রি করে দিয়ে গ্রামের বাইরে টেলারিংয়ের দোকান খুলেছেন। মণ্টুবাবু বলেন, ‘‘বছর কয়েক আগেও আমার গোটা কয়েক গাধা ছিল। কিন্তু এখন তেমন ভাড়া হয় না। তাই পেশা বদলে নিয়েছি।’’

স্থানীয় বাসিন্দা কৃষ্ণপদ সাঁতরা বলেন, ‘‘প্রজাপতি পদবির লোকজনই মূলত এই গ্রামে গাধার ব্যবসা করতেন। এখন তাদের সংখ্যা কমে গিয়েছে। যাঁরা রয়েছেন তাঁরা খুবই কষ্টে দিনযাপন করেন।’’

সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একটি গাধার পিঠে খড় চাপাচ্ছিলেন লক্ষ্মণবাবু। বেশি রোজগারের জন্য আপনিও অন্য পেশায় যাচ্ছেন না কেন? প্রশ্ন শুনে খানিক থামলেন তিনি। তার পর আস্তে আস্তে বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘গাধারা আমাদের পরিবারের অংশ। কী করে ছেড়ে দিই বলুন তো?’’

আশ্চর্য হলেও মুম্বই রোড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের এই জনপদে এখনও এটাই সত্যি।

state news donkey
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy