এই সেই নববর্ষের আমন্ত্রণপত্র।
রামনবমীর পালা শেষ হওয়ার পর এ বার কি নববর্ষকে ঘিরে হিন্দুত্বের নতুন চিত্রনাট্য দেখবে বাংলা? পয়লা বৈশাখে রাস্তায় নেমে বাঙালির ‘হিন্দুত্ব’কে সামনে আনার প্রস্তুতি তুঙ্গে। যার মূল দাবি, আকবর বা টোডরমল নন, বাংলা সনের প্রবর্তক গৌড়রাজ শশাঙ্ক! ইতিহাসে এর পাথুরে প্রমাণ না থাকলেও প্রথমে কলকাতায়, পরে রাজ্য জুড়ে এই বার্তা প্রচারের পথে সঙ্ঘ পরিবারের অনুগামীরা।
সঙ্ঘের আদর্শে চলা ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’ পয়লা বৈশাখের দিন বড় সমাবেশ করতে চলেছে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরে। সঙ্গে থাকবে প্রাচীন ধারার কীর্তন গাইয়ে, শ্রীখোল বাদকের দল, শশাঙ্কের নামাঙ্কিত ট্যাবলো, ধ্বজ-চামর-উষ্ণীষ-মুকুটে সজ্জিত শোভাযাত্রা, পথনাটিকার আসর। এই সাংস্কৃতিক শোভাযাত্রা ওই চত্বরে একত্রিত হওয়ার পর তারা গোটা এলাকাটি পাক দেবে কীর্তন-খোল সহযোগে। শিশির মঞ্চ ঘুরে মুক্তমঞ্চে এসে ছোট ছোট অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হবে বাংলার ‘হৃতগৌরব’। সব শেষে একটি দাবি সনদের ঘোষণাও করা হবে।
বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠা হয় ২০১৯ সালে, যে বছর দ্বিতীয় বারের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে মোদী সরকার। সংগঠনের সম্পাদক প্রবীর ভট্টাচার্যের দাবি, “অতীতে ভারতের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল বঙ্গাব্দের প্রবর্তন নিয়ে ভ্রান্ত দাবি। বঙ্গাব্দ রচনা বাঙালির নিজস্ব কৃতিত্ব, যদিও মোগলরা তা নিজেদের গৌরব বলে দাবি করে এসেছে। অথচ টোডরমল কখনও বাংলায় আসেননি, বাংলা নিয়ে তাঁর বা আকবরের আলাদা করে মাথাব্যথা থাকারও কোনও কারণ নেই। ঘটনা এটাই যে, ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা এবং পরে গৌড়ের শাসক শশাঙ্ক নিজের শাসনকালের সূচনাকে চিহ্নিত করে রাখার জন্য বর্ষপঞ্জী হিসাবে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রায় এই অতীত ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করব আমরা।”
কিন্তু ইতিহাস কি এই দাবি আদৌ সমর্থন করে? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী জানালেন, শশাঙ্ক তাঁর নিজের রাজত্বকালে তাম্রশাসনে অন্তত পাঁচটি নিষ্কর ভূদান করেছিলেন। ‘‘তিনি যদি অব্দ জারি করেই থাকবেন, তা হলে তো এই দানে সেই অব্দের উল্লেখ থাকত! কিন্তু কোথাও তা নেই। এমনকি তাঁর অধীনস্থ রাজাদের ভূসম্পদ দানের ক্ষেত্রেও গুপ্তাব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার থেকে শুরু করে কোনও প্রবীণ পেশাদার ইতিহাসবিদ শশাঙ্কের সময় থেকে বঙ্গাব্দের সূচনার কথা লেখেননি। তবু অনেক দিন থেকেই কেউ কেউ এটা বলার চেষ্টা করছেন। ওঁরা সূর্যসিদ্ধান্ত নামে এক প্রাচীন গ্রন্থের ভিত্তিতে এই দাবি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শশাঙ্কের রাজত্বকালের সঙ্গে সূর্যসিদ্ধান্ত বইটির সময়কালের মিল নেই। সুতরাং এ দাবি অমূলক।’’
পরিষদের বক্তব্য হল, বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে নবীন প্রজন্মকে পরিচিত করানোটাই হল লক্ষ্য, এর সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে কোনও সম্প্রদায়ের মন জয় করার সম্পর্ক নেই। প্রবীরের কথায়, “২০১৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রকাশের পর আমরা দেখলাম যে তামিল, কন্নড়ের মতো ভাষা শাস্ত্রীয় মর্যাদা পেলেও পিছিয়ে পড়ছে বাংলা। তখনই অনেকে একত্রিত হয়ে আঞ্চলিক স্তরে কাজ শুরু করি। আমাদের সংগঠন সঙ্ঘ পরিবার প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু হ্যাঁ, অবশ্যই আদর্শগত ভাবে আমরা সঙ্ঘের সঙ্গেই রয়েছি।”
রাজনৈতিক শিবির অবশ্য মনে করছে, এই কর্মসূচির পিছনে সঙ্ঘ পরিবারের সাংস্কৃতিক হিন্দুত্ববাদকে বাংলায় প্রচারের কৌশল রয়েছে। নববর্ষের এই নতুন ‘ভাষ্য’টির সঙ্গে মানুষকে সংযুক্ত করা, রামনবমীতে জনজোয়ার তৈরির চেষ্টার তুলনায় বেশি ফলপ্রসূ হবে, এমনটাও মনে করা হচ্ছে। দোরগোড়ায় পঞ্চায়েত ভোট। তার পরই দামামা বেজে যাবে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের। প্রতিটি জেলা থেকে রামের শোভাযাত্রা বার করে রামভক্তির জোয়ার বওয়ানোর চেষ্টা হয়েছে সদ্য। কিন্তু এ কথাও গেরুয়া শিবিরের অজানা নয় যে, রাম বাঙালির কাছে মূলত এক মহাকাব্যিক চরিত্র। উত্তর ভারতে তাঁর সঙ্গে যে ভাবে আধ্যাত্মিক আবেগ জড়িয়ে রয়েছে, বঙ্গে তা নেই। কিন্তু বাঙালির হিন্দুত্বের পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসে তাকে বাদশাহি আমল থেকে ছিন্ন করতে পারলে লাভ অনেকটাই বেশি।
সম্প্রতি এনসিইআরটি-র দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে মোগল যুগের ইতিহাস। ইতিহাসবিদদের একটি বড় অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তা নিয়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গাব্দ সূচনার কৃতিত্ব থেকে আকবরকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকেও রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy