Advertisement
১৭ মে ২০২৪

সিন্ডিকেটে মোদীকে পাল্টা সব্যসাচীর

শিল্পহীন রাজ্যের বাস্তব বুঝে সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে সরব হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর পত্রপাঠ প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন নিউটাউনের তৃণমূল প্রার্থী তথা বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত! সিন্ডিকেট যে এখন এ রাজ্যের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ফের তা স্পষ্ট হয়ে গেল রবিবার!

দুর্নীতির চক্র। ময়দানের সভায় বোঝাচ্ছেন মোদী। ছবি : বিশ্বনাথ বণিক।

দুর্নীতির চক্র। ময়দানের সভায় বোঝাচ্ছেন মোদী। ছবি : বিশ্বনাথ বণিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:০৪
Share: Save:

শিল্পহীন রাজ্যের বাস্তব বুঝে সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে সরব হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর পত্রপাঠ প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন নিউটাউনের তৃণমূল প্রার্থী তথা বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত! সিন্ডিকেট যে এখন এ রাজ্যের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ফের তা স্পষ্ট হয়ে গেল রবিবার!

রাজ্যে ভোটের মাঝে তৃতীয় বারের জন্য প্রচারে এসে কৃষ্ণনগর এবং কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে মোদী এ দিন পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট-রাজ বন্ধেরই ডাক দিয়েছেন। বাম আমলেও সিন্ডিকেট সংস্কৃতি চলত বলে উল্লেখ করে দিদির রাজত্বকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, সিন্ডিকেট-রাজের অবসান ঘটাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উৎখাত করতে হবে।

মোদীর এই বক্তব্যকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন সব্যসাচী। তৃণমূলের মধ্যে সিন্ডিকেট-রাজের প্রবক্তা হিসাবে যাঁর ইদানীং খ্যাতি জুটেছে ভালই। একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলের সাম্প্রতিক স্টিং সেই খ্যাতিকে আরও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে! সেই সব্যসাচী এ দিন বলেছেন, ‘‘যাকে সিন্ডিকেট বলা হচ্ছে, সেগুলো আসলে সমবায় সমিতি। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে তাদের অ্যাকাউন্টও আছে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা থাকলে তিনি সংসদে বিল এনে এই ধরনের সমিতি এবং তাদের অ্যাকউন্ট করার অধিকার বন্ধ করে দিন না! দেখব, কত বড় সাধ্য তাঁর!’’ মোদীর উদ্দেশে সব্যসাচীর আরও মন্তব্য, ‘‘এত বড় বড় কথা বলছেন! আমার কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীর জামানত জব্দ করে তার যোগ্য জবাব দিয়ে দেব!’’ প্রসঙ্গ

কৃষ্ণনগরের সভায় এ দিন মোদী বলেন, ‘‘বামেদেরও সিন্ডিকেট সংস্কৃতি ছিল। মমতাদিদিও সিন্ডিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙেছে সিন্ডিকেট সংস্কৃতির জন্যই।’’ পরে কলকাতার সভায় মোদীর মন্তব্য, ‘‘উড়ালপুল ভেঙে যাঁদের মৃত্যু হল, যাঁরা স্বজন হারালেন, তাঁদের কী দোষ ছিল? আমরা দেখেছি, যারা নারদ-কাণ্ডে যুক্ত, তারাই সারদায় জড়িত। যারা সারদায় জড়িত, তারাই উড়ালপুলের ঘটনায় নজরে আসছে। তার মানে পাপের পরম্পরায় এরাই যুক্ত!’’ এই প্রেক্ষিতেই শ্রোতাদের উদ্দেশে মোদীর প্রশ্ন, ‘‘আপনারা কি এই সিন্ডিকেট সংস্কৃতি চলতে দেবেন?’’ কয়েক দিন আগে একটি মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, এখানে সিন্ডিকেট ছাড়া কিছুই চলে না। সেই প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, হাইকোর্ট যে বিচার করেনি, সেটা করার ক্ষমতা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের। মোদীর আহ্বান, ‘‘ওদের এমন সাজা দিন, যাতে ভবিষ্যতে আর পাপ করতে হাত না ওঠে!’’

বস্তুত, সিন্ডিকেটের প্রচলন এ রাজ্য দেখেছে বাম আমলেই। তৎকালীন শাসক দলের সঙ্গে প্রোমোটার-রাজ এবং সিন্ডিকেটের ওঠাবসা বাড়ছে দেখে পার্টি চিঠিতে দলের কর্মীদের এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন সিপিএমের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। সেই পার্টি চিঠির এক যুগ পরেও ওই প্রবণতা বন্ধ হয়নি। বরং, নির্মাণ ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় এলাকায় সিপিএমের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সিন্ডিকেটের যোগসাজশ বেড়েই চলেছিল। ইতিহাস বলে, যে কোনও অপরাধই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও ডালপালা মেলে। পরিবর্তনের পরে তৃণমূলের জমানায় তা-ই ঘটেছে। তার উপরে শিল্পায়নের বেহাল দশায় কর্মসংস্থানের অভাব যত প্রকট হয়েছে, ততই রোজগারের আশায় সিন্ডিকেটে নাম লিখিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। আর লেনদেনের অঙ্কে তাদের পিছনে দাঁড়িয়েছে শাসক দল। তৃণমূল নেত্রী মমতা বহু বার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মৌখিক হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি।

শিল্প ও বণিক মহলের একাংশের মতে, সিন্ডিকেটের অবাধ দাপট এখন বিষচক্রের পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছে। শিল্প নেই বলে সিন্ডিকেট আঁকড়ে এক ধরনের আর্থ-সামাজিক নির্ভরতা বাড়ছে। আবার সিন্ডিকেটের জুলুমে চালু শিল্পকেও বারেবারে নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে অজস্র বার নালিশ জানিয়েও যার কোনও প্রতিকার মেলেনি। বরং, দুষ্টচক্রের আরও আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে রাজ্য।

পশ্চিমবঙ্গের এই বাস্তব ছবিকেই এ দিন তুলে ধরতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বামেরাও সিন্ডিকেট চালাত। বামেরা যা যা খারাপ কাজ করত, সব ক’টাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন দিদি!’’ এ রাজ্য থেকে যুবকেরা কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে বিজেপি-কেই সরকারে আনতে হবে বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

তাদের আমলে যে সিন্ডিকেট মাথা তুলেছিল, সেই সত্য মেনে নিয়েই ক্ষমতায় ফিরলে এই চক্র বন্ধ করার আশ্বাস দিয়েছে সিপিএম। দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘আমাদের সময়ে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সিন্ডিকেট যে ভাবে শুরু হয়েছিল, মমতার আমলে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে! রাজ্যে বিকল্প সরকার এলে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সিন্ডিকেট, রাজনীতি এবং প্রশাসনের এই আঁতাঁত আমরাই ভেঙে দেব। বিজেপি এসে সিন্ডিকেট-মুক্ত রাজ্য গড়বে, এটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই!’’ সেলিমের দাবি, নির্মাণ শিল্পকে ঘিরে সিন্ডিকেট সর্বত্র আছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কেন্দ্র গাজিয়াবাদেও আছে। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনীতির মদতে তার এমন চেহারা এ রাজ্যেই প্রকট।

মোদীর সুরে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহও বলেছেন, ‘‘সিন্ডিকেট একটা গা-জোয়ারি। রোজগারের কথা ভেবে এটা চলতে দিলে তো চুরি-ডাকাতিকেও একই যুক্তিতে বৈধ ঘোষণা করতে হয়! বিজেপি সরকারে এলে মানুষের যা কর্মসংস্থান হবে, তাতে সমান্তরাল রোজগারের প্রয়োজন হবে না।’’ বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভাঙার পিছনে সিন্ডিকেট রয়েছে জানিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যে ক্ষতিকর দিকটা অনুধাবন করেছেন, এটা ভাল। কিন্তু এটা ক্ষতিকারক হলে সরকার সংসদে আইন করে তা বন্ধ করুক। মোদী তা করছেন না। কারণ তাতে তাঁর নিজের গায়েই আঘাত পড়বে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 syndicate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE