Advertisement
E-Paper

সব্যসাচীর মুখেই অস্বস্তির সিন্ডিকেট

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, মারামারি-বোমাবাজি চলছিলই। তা নিয়ে শাসক দলের অন্দরে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের পালাও অব্যাহত ছিল। তার মধ্যেই শাসক দলের অস্বস্তি বহু গুণ বাড়িয়ে রাজারহাটের সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে এ বার বিধানসভার অন্দরেই মুখ খুললেন তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০৩:৪০

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, মারামারি-বোমাবাজি চলছিলই। তা নিয়ে শাসক দলের অন্দরে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের পালাও অব্যাহত ছিল। তার মধ্যেই শাসক দলের অস্বস্তি বহু গুণ বাড়িয়ে রাজারহাটের সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে এ বার বিধানসভার অন্দরেই মুখ খুললেন তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত।

বুধবার বিধানসভায় পুর ও নগরোন্নয়ন বিভাগের বাজেট বিতর্কে অংশ নিয়ে নিউটাউনে সিন্ডিকেট-রাজের প্রসঙ্গ তোলেন ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক বিশ্বনাথ কাঁড়ার। সিন্ডিকেট ব্যবসাকে ঘিরে শাসক দলের দু’পক্ষের মারামারির প্রসঙ্গও টেনে আনেন তিনি। তার পরেই বলতে উঠে রাজারহাটের বিধায়ক সব্যসাচীবাবু বলেন, ‘‘নিউটাউন-রাজারহাটে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের সিন্ডিকেট আছে এবং চলছে।’’ একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘ইমারতি দ্রব্যের কারবার তো বেআইনি নয়। কেউ এই কারবার করলে কে আটকাবে তাদের!’’

এ দিন বাজেট-বিতর্কে যোগ দিয়ে রাজারহাটের বিধায়ক জানান, রাতারাতি এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থা তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর দাবি, রাজারহাটে নিয়ম মেনেই কাজ-কারবার চালাচ্ছে সিন্ডিকেটগুলি। একই সঙ্গে এই বিধায়কের অভিযোগ, সিন্ডিকেট ব্যবস্থা তৃণমূল শুরু করেনি। বাম জমানায় তৎকালীন আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেবই নিউটাউনে সিন্ডিকেট প্রথার জনক। এ নিয়ে বর্তমান শাসক দলকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

রাজারহাটে সিন্ডিকেট ব্যবসার জনক বলে যাঁকে তিনি কটাক্ষ করেছেন, সেই প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব এ দিন সব্যসাচীবাবুকে সমর্থনের পাশাপাশি বিঁধতেও ছাড়েননি। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘সব্যসাচী আংশিক সত্যি কথা বলেছেন। ফিরহাদ ঠিক বলেননি।’’ ব্যাখ্যা করে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী বলেন, ‘‘যাঁরা নিউটাউনের জন্য জমি দিয়েছেন, তাঁদের বিকল্প রুজির ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর পরামর্শেই জমিহারাদের নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়।’’ এর পরেই তাঁর অভিযোগ, ‘‘এখন সিমেন্ট-বালি সরবরাহের নামে লুঠপাট চলছে! তাই সিন্ডিকেট নিয়ে এত অভিযোগ।’’

সিন্ডিকেট ব্যবসা নিয়ম মেনে চলছে বলে সব্যসাচীবাবু দাবি করলেও বাস্তবে কিন্তু গৌতমবাবুর অভিযোগই স্বীকৃতি পেয়েছে রাজরহাটের ব্যবসায়ী মহলে। তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, সিন্ডিকেটের দাপট এতটাই যে, সেখানে বেশি দামে পরিমাণে কম এবং গুণগত ভাবে খারাপ মাল নিতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেট-কর্তাদে‌র কথা না শুনলে রাজারহাট-নিউটাউনে ব্যবসা করা রীতিমতো অসম্ভব। সিন্ডিকেটের চাপে বেশি দামে খারাপ মাল নিতে রাজি না হওয়ায় সাম্প্রতিক অতীতে রাজারহাট থেকে ব্যবসা গুটিয়ে রাজ্য থেকে ফিরেও যেতে হয়েছে এক অনাবাসী ব্যবসায়ীকে! আরও একাধিক সংস্থার কপালেও জুটেছে নানা হেনস্থা। সিন্ডিকেটের জুলুম নিয়ে একাধিক বার প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পরিস্থিতি যে কে সেই!

সিন্ডিকেট নিয়ে বিধানসভার অন্দরে সব্যসাচীবাবুর বক্তব্যে এ দিন তুমুল অস্বস্তিতে পড়ে যায় শাসক শিবির। নিউটাউন-রাজারহাটে সিন্ডিকেটের দখলদারি নিয়ে শাসক দলের যে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মারামারি-গন্ডগোল চলছে, তার এক পক্ষের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে বারেবারেই আঙুল উঠেছে সব্যসাচীবাবুর দিকে। স্বভাবতই বিধানসভা কক্ষে তাঁর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়।

সিন্ডিকেট-অস্বস্তি এড়াতে অবশ্য অস্বীকারের চিরাচরিত পথেই হেঁটেছে শাসক দল! সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে সব্যসাচীর স্বীকারোক্তিকে প্রকাশ্যে আমলই দিচ্ছে না মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল। রাজ্যের নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্য, ‘‘আমি তো নিউটাউনে যাতায়াত করি। আমার তো সিন্ডিকেট বলে কিছু চোখে পড়ছে না!’’ একই সঙ্গে ফিরহাদ বলেন, ‘‘রাজারহাটে নথিভুক্ত-অনথিভুক্ত কোনও সিন্ডিকেটের কথাই আমার জানা নেই। স্থানীয় বিধায়ক বলেছেন। তাঁর এলাকায় কী আছে না আছে, আমার জানা নেই।’’ রাজারহাটে সিন্ডিকেটের দখলদারি নিয়ে যাঁর সঙ্গে সব্যসাচীবাবুর অনুগামীদের মূল লড়াই, তৃণমূলের সেই সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার এই মুহূর্তে মুম্বইয়ে রয়েছেন। তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি মুখ খুলতে চাননি।

প্রত্যাশিত ভাবেই বিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে সরকার পক্ষকে বিঁধতে ছাড়েনি। সব্যসাচীবাবুর বক্তব্য বিধানসভার কার্যবিবরণীতে নথিভুক্ত হয়ে যাওয়ায় তাঁরা সুরও চড়ান। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘নিউটাউনের স্থানীয় বিধায়ক হিসেবে সব্যসাচীবাবু বাস্তব অবস্থার কথা বলেছেন। আর ফিরহাদ মন্ত্রী হওয়ার দায়বদ্ধতায় অস্বীকার করেছেন!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘সব্যসাচীর এই স্বীকারোক্তির জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। কারণ, সল্টলেক ও রাজারহাটের মানুষ সব্যসাচীকে সিন্ডিকেট নিয়ে রাস্তায় মারামারি করতে দেখেছেন!’’প্রশ্ন উঠেছে, সব্যসাচী কেন এ কথা বললেন? বিধানসভার বাইরে তাঁর নিজের ব্যাখ্যা, ‘‘ইট-বালি-পাথর তো নিষিদ্ধ বস্তু নয় যে তার ব্যবসা করা যাবে না! আইন মেনে কেউ ব্যবসা করলে কেন তাদের আটকানো হবে? পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে এ সব বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় নাকি!’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘যে কারবার বহু আগে থেকেই চলছে, হঠাৎ করে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে তা বন্ধ করা হবে কেন?’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি আরও বলেন, ‘‘শশী পাঁজার এলাকায় একটি যৌনপল্লিতে ৩০ হাজার ভোটার রয়েছে। ফিরহাদ হাকিমের এলাকায় ফ্যান্সি মার্কেট রয়েছে। সে সবও তো তা হলে তুলে দিতে হয়!’’ বিধায়কের যুক্তি, ‘‘আমার বিধানসভা এলাকায় ১২ হাজার যুবক ইমারতি দ্রব্যের কারবার চালান। এদের পরিবার ধরলে অন্তত ৬০ হাজার মানুষের রুজিরুটি চলছে। জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোই আমার কর্তব্য।’’

তৃণমূলের একটি অংশের ব্যাখ্যা, সিন্ডিকেট ব্যবসার মধ্যে দোষ দেখেন না মুখ্যমন্ত্রীও। একাধিক বার তিনি তা বলেওছেন। সব্যসাচী এ দিন যা বললেন, তা মুখ্যমন্ত্রীর কথারই প্রতিধ্বনি। তবে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ম মেনে সিন্ডিকেট ব্যবসা করার কথা বললেও সেটা রাজারহাটে মানা হচ্ছে কি না— সেই প্রশ্ন বারেবারেই উঠেছে। এ নিয়ে শাসক দলের কাছে অসংখ্য বার অভিযোগও করেছেন একাধিক ব্যবসায়ী। তার পরেও কোনও সুরাহা হয়নি। এমনকী দলের মধ্যেও সিন্ডিকেট-বিতর্ক কম নয়।
এই পরিস্থিতিতে রাজারহাটের বিধায়কের মন্তব্যের পরে দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘‘বিধানসভায় সব্যসাচী বিষয়টি নিয়ে মুখ না খুললেই ভাল করতেন।’’

রাজারহাটের সাধারণ বাসিন্দা তো বটেই, পুলিশ-প্রশাসন এমনকী শাসক দলের বহু নেতাও বলছেন, নিউটাউন-রাজারহাটে সিন্ডিকেট ব্যবসার নামে ত্রাসের রাজত্ব তৈরি হয়েছে। ইমারতি ব্যবসার নামে বোমা-বন্দুক নিয়ে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে স্থানীয়রা যে আতঙ্কিত, তা অস্বীকার করেন না তৃণমূলের স্থানীয় নেতারাও।

কেমন ভাবে চলে এই সিন্ডিকেট রাজ?

বাম আমলে রাজারহাট উপনগরীর হাত ধরে যে সিন্ডিকেট ব্যবসার সূত্রপাত, এখন সেটাই প্রায় মহীরূহের চেহারা নিয়েছে।। তখন জমিহারাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই ছিল সিন্ডিকেটের লক্ষ্য। এখন কর্মসংস্থানের জায়গা নিয়েছে মূলত ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের কারবার। পুলিশের বক্তব্য, বাম আমলের শেষের দিকে সিন্ডিকেট-সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত গৌর, রুইস মণ্ডল-সহ কয়েক জনের হাতে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সইফুল, ভজাই, মুনিয়া, আফতাবউদ্দিন, শিবুর মতো আরও অনেক নাম। স্থানীয় সূত্রের খবর, সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষের বলি হতে হয়েছে কেষ্টপুরের স্বপন মণ্ডলকে। ২০১১-র নভেম্বরের তাঁকে গুলি করে হত্যা করে দুষ্কৃতীরা। সেই সূত্র ধরেই সিন্ডিকেট ব্যবসার রমরমার কথা প্রকাশ্যে আসে। এই ব্যবসায় তৃণমূলের এক সাংসদ, এক বিধায়ক এবং রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর পরোক্ষ মদত থাকার অভিযোগ উঠতে শুরু করে।

পরিস্থিতি বদলায় ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজারহাটে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর থেকে। দলীয় সূত্রে খবর, পঞ্চায়েত ভোটের পরেই রাজারহাটের রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেকটাই ‘দখল’ করে নেয় বিধায়কের অনুগামীরা। ভজাই, সইফুলরা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তুলনায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আফতাবউদ্দিন, রাজীব দাস-সহ সাংসদের অনুগামীরা। গত লোকসভা ভোটে স্থানীয় বিধায়কের সহযোগিতা ছাড়াই রাজারহাট-নিউটাউন এলাকায় ১৬ হাজারেরও বেশি ভোট পান কাকলিদেবী। এতে বাড়তি অক্সিজেন পায় তাঁর অনুগামীরা। তার পর থেকেই দু’পক্ষের গোলমাল, সংঘর্ষ শুরু হয়। বিশেষত, বালিগুড়ি, মহিষবাথান, ঠাকুরদারি, নবাবপুরের মতো এলাকা, যেখানে বিধায়ক-শিবিরের প্রাধান্য বেশি ছিল, সেখানেও এলাকা দখল নিয়ে গোলমাল শুরু হয়ে যায়।

দলীয় সূত্রের খবর, বর্তমানে সিন্ডিকেট দখলের প্রশ্নে সাংসদকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছেন সব্যসাচী। অনেকের মতে, এ দিন প্রকাশ্যে সিন্ডিকেটের পক্ষে সওয়াল করে আসলে তাঁর অনুগামীদের বলভরসাই জোগালেন বিধায়ক!

Bobby Hakim Sabyasachi Dutta Syndicate Rajarhat New town
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy