Advertisement
E-Paper

দ্বন্দ্ব মেটানোর বৈঠকে বিধায়ককে ‘চোর’ বললেন নেতা

যবনিকা উঠেছিল ভরদুপুরে। যখন যবনিকা পড়ল, মেঘলা দিনে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। মাঝের পাঁচ ঘণ্টায় কী আর ঘটা বাকি রইল? রাজ্যের দুই মন্ত্রীর সামনে অবৈধ বালি খাদান নিয়ে ফাটাফাটি হল। আঙুল তুলে এক বিধায়ককে ‘চোর’ বললেন দলেরই এক নেতা।

সৌমেন দত্ত ও কেদারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৪

যবনিকা উঠেছিল ভরদুপুরে। যখন যবনিকা পড়ল, মেঘলা দিনে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে।

মাঝের পাঁচ ঘণ্টায় কী আর ঘটা বাকি রইল?

রাজ্যের দুই মন্ত্রীর সামনে অবৈধ বালি খাদান নিয়ে ফাটাফাটি হল। আঙুল তুলে এক বিধায়ককে ‘চোর’ বললেন দলেরই এক নেতা।

বিধায়ক রুখে উঠলেন, ‘আমি চোর! আমার বংশপরিচয় জানেন?’ বলেই কেঁদে ভাসালেন, পাঞ্জাবির বুক-টুক ভিজে গেল।

আগের দিনই দলের এক নেতাকে মারার জন্য ৬ লক্ষ টাকা ‘সুপারি’ দিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে লোক আনার অভিযোগ উঠেছিল আর এক নেতার বিরুদ্ধে। শুক্রবার পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। দু’জনকেই দল থেকে তাড়িয়ে দিতে বললেন নেতৃত্ব।

গোষ্ঠী কোন্দলে লাগাম পরাতেই এই বৈঠক। অথচ গোষ্ঠীবাজি থেকে তোলাবাজি— সব কিছুর জন্য খোদ জেলা সভাপতিকেই (তিনিও মন্ত্রী) দায়ী করলেন এক বিধায়ক-সহ তিন নেতা। পরে গড়ে দেওয়া হল জেলার ‘কোর কমিটি’।

এ দিন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ম্যারাথন বৈঠকে নাটকের অজস্র উপাদান ছড়িয়ে রইল।

দলটির নাম তৃণমূল কংগ্রেস।

ঘটনাস্থল, নিউ আলিপুরে একটি ক্লাবঘর। যেখানে বর্ধমানের নেতাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন ক্লাবের হোতা, রাজ্যের যুব কল্যাণ মন্ত্রী তথা তৃণমূলের বর্ধমান জেলা পর্যবেক্ষক অরূপ বিশ্বাস।

সেই বর্ধমান, যেখানে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মারামারি, খুনোখুনি, কাদা ছোড়াছুড়ি প্রায় নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জেলায় আগামী ১৫ জুলাই তাঁর শততম প্রশাসনিক সভা করতে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং তার আগে ঘর সামলানোর জন্য মরিয়া তৃণমূল। এমনকী বৈঠক চলাকালীন মুখ্যমন্ত্রী নিজেও একাধিক বার খবর নিয়েছেন বলে কয়েক জন নেতার দাবি।

অরূপবাবু অবশ্য দাবি করেন, “কোনও বৈঠকই হয় নি।” তৃণমূলের বর্ধমান জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ কোনও উত্তরই দিতে চাননি। বৈঠকে সব নেতাদেরও বলে দেওয়া হয়েছে, কেউ যেন মুখ না খোলেন। দিনভর যাঁকেই ফোন করা হয়েছে, বাঁধা গতে জবাব— “এক পরিচিতকে দেখতে এসএসকেএম হাসপাতালে এসেছি। হাসপাতালের ভিতর রয়েছি।” কে পরিচিত? মদন মিত্র না কি? ‘‘আরে না না, অন্য এক জন...। (হাসি)’’ ‘হাসপাতাল’ থেকে বেরিয়ে বর্ধমানে পৌঁছতে তাঁদের রাত হয়ে গেল।

তৃণমূল সূত্রের খবর, অরূপবাবু ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন আসানসোলের নেতা তথা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। তাঁদের সামনেই বেশির ভাগ ব্লকের নেতারা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তোপ দাগতে থাকেন। দক্ষিণ দামোদর এলাকায় বালি খাদানের দখল নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ইতিমধ্যে দলের কর্মী খুন হয়েছেন। বৈঠকে অনেকেই অভিযোগ করেন, ‘দামোদর লাগোয়া গ্রাম পঞ্চায়েত দখল নিয়েই যত গণ্ডগোল। কারণ ওই সব পঞ্চায়েতগুলি দখলে রাখতে পারলেই খাদানে দখল নেওয়া যায়। আর বালি মানেই কাঁচা টাকা!”

বৈঠকে হাজির থাকা একাধিক নেতার দাবি, এই নিয়ে কথা চলতে-চলতেই জামালপুরের এক নেতা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘‘বিধায়কের মাধ্যমেই বালিঘাট চলে। বালি খাদান থেকে ও-ই টাকা নেয়। ও-ই চোর।’’ শুনেই উঠে দাঁড়ান বিধায়ক। বুক ঠুকে অরূপবাবুকে তিনি বলতে থাকেন, ‘‘আমি চোর! কোন পরিবারের লোক জানেন? আমার দাদু বর্ধমানের চেয়ারম্যান ছিলেন, আমার বাবা বিধায়ক ছিলেন। আমাদের পরিবার চোর!’’ বলতে-বলতেই হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি। অন্যেরা কোনও মতে তাঁকে সামলান।

তৃণমূল সূত্রের খবর, অন্য কিছু ব্লকের নেতাদের একাংশ ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একশো দিনের কাজে বিনা টেন্ডারে গাছ কেটে টাকা আত্মসাতের‌ও অভিযোগ তোলেন। পরে পর্যবেক্ষক বলেন, “এ ভাবে পরস্পরের দিকে আঙুল তুলবেন না। নিজেদের সম্মান বজায় রাখুন। বালির মতো গভীর সমস্যা এই বৈঠকে আলোচনা করা যাবে না। আমরা শুধু বালি খাদান নিয়েই বর্ধমানে একটি বৈঠক করব।”

বৃহস্পতিবার কালনায় বোমা ফেটে এক যুবক জখম হওয়ার পরে স্থানীয় সুলতানপুর পঞ্চায়েতের প্রধান সুকুর শেখ অভিযোগ করেন, তাঁকে খুন করার জন্যই ওই বোমা বাঁধা হচ্ছিল। ৬ লক্ষ টাকা দিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে ওই ভাড়াটে লোকজনকে এনেছিলেন কালনা ১ পঞ্চায়েত সমিতির ভূমি ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ সাদেক শেখ। এ দিন সুকুর শেখ কালনা থানায় লিখিত অভিযোগ জানান। তৃণমূল সূত্রের দাবি, বৈঠকে দুই নেতার নাম ধরে ডাকেন অরূপবাবু। সুকুর আসেননি। সাদেক অভিযোগ অস্বীকার করলেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা মেনে নেন। তবে তাঁর দাবি, বিষয়টি জেনেও দল তেমন কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। স্বপনবাবু অবশ্য পাল্টা বলেন, বিষয়টি মেটাতে জন্য একাধিক বার চেষ্টা হয়েছে। এর পরেই অরূপবাবু সাদেক-সুকুর দু’জনকেই বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন।

জেলা সভাপতির ভূমিকা নিয়ে গত কিছু দিন ধরেই প্রশ্ন উঠছিল। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, বাম আমল থেকে বর্ধমানে জিতে আসা বহু পুরনো এক কাউন্সিলর, মলয় ঘটকের ঘনিষ্ঠ মেমারির এক নেতা এবং এক বিধায়ক বৈঠকে অভিযোগ করেন— ‘‘দলে যে গোষ্ঠী কোন্দল, খুনোখুনি, তোলাবাজি চলছে, সব জেলা সভাপতির জন্য। গোষ্ঠীবাজিতে উনিই মদত দিচ্ছেন। কোনও বৈঠক হলে আমাদের জানানই না।’’ জেলা সভাপতিকে শুধু বলতে শোনা যায়, ‘‘আমি কী করব? আমি কী করব?’’ যদিও পরে স্বপনবাবু গোটা বিষয়টি নিয়ে কোনও কথাই বলতে চাননি।

পরে স্বপন দেবনাথকেই সভাপতি করে সব বিধায়ক-সহ শতাধিক নেতাকে নিয়ে একটি ‘কোর

কমিটি’ গঠন করা হয়। তাঁরা জেলা দফতরে মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ শনিবার বৈঠক করবেন। কোর কমিটির সদস্যদের মাসে অন্তত একদিন জেলা দফতরে বসার নির্দেশও দিয়েছেন পর্যবেক্ষক। স্বপনবাবুকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বৈঠক করা হয়। এ ছাড়াও বিধায়কদের নেতৃত্বে প্রতি বিধানসভা কেন্দ্রে একটি করে ‘কোর কমিটি’ গড়া হবে। তাঁরাও প্রতি মাসে বৈঠক করে সরাসরি পর্যবেক্ষকের কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন। বৈঠকে উপস্থিত জেলার এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার মতে, “এ ভাবে আসলে জেলা সভাপতির ডানা ছেঁটে নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলেন অরূপ বিশ্বাস।”

তবে সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিকের টিপ্পনী, “এত করেও কি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আটকানো যাবে? পুরোটাই তো বেনোজল!”

trinamool Sadek Sukur bardhaman leader
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy