হাড়োয়ার এক নিখোঁজ স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করতে নেমে বসিরহাটে এক মহিলার বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। সেখান থেকে উদ্ধার হয় আর এক স্কুলছাত্রী। দু’জনকে একই ব্যক্তি প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের লোভ দেখিয়েছিল, জানতে পেরেছে পুলিশ। আন্তঃরাজ্য পাচারচক্রের সঙ্গে যুক্ত ওই যুবক ও দুই মহিলাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দিল্লি থেকে উদ্ধার হয়েছে হাড়োয়ার কিশোরীও। দুই জেলার আরও বেশ কিছু কিশোরীকে ওই চক্র যৌনব্যবসায় নামতে বাধ্য করেছে বলে আন্দাজ পুলিশের।
উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরি জানিয়েছেন, ধৃতদের নাম, সাব্বির খান, তানজিরা খাতুন এবং মুসলিমা গায়েন। তানজিরা ওরফে সোনালি বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ভাব করত স্কুল ছাত্রীদের সঙ্গে। তারপর সেই মেয়েদের আলাপ করিয়ে দিত ৩০ বছরের সুদর্শন যুবক সাব্বির খানের সঙ্গে। রোহিত, রণিত, রোহন, নানা নাম নিয়ে সাব্বির প্রেমের অভিনয় করত। বিয়ের নাম করে পাঠিয়ে দিত দিল্লি। পাশাপাশি মাদক পাচারের কাজও করত সাব্বির। দিল্লির যৌনপল্লির একটি কোঠার মালিক মুসলিমা (ওরফে রোশনি ওরফে পিঙ্কি) সেই মেয়েদের জোর করে দেহ ব্যবসায় নামাত। ধৃতদের সোমবার বারাসত আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেয়।
নারী ও নাবালিকা পাচারে পশ্চিমবঙ্গ এখন শীর্ষে। ২০১২ সালের জাতীয় ক্রাইম ব্যুরো রেকর্ড অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৫৪৯ জন মহিলা পাচার হয়েছে, যাদের ৩৬৯ জনই নাবালিকা। ভারতে যৌনব্যবসার জন্য নাবালিকা পাচারের যত মামলা হয়েছে, তার ৪৫ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সীমান্ত-ঘেঁষা এলাকা এবং উত্তরবঙ্গের চা বাগান, রাজ্যের এই দুটি জায়গা অত্যন্ত পাচারপ্রবণ। দিল্লি, পুনে, বেঙ্গালুরু প্রভৃতি নানা শহর থেকে এ রাজ্যের কিশোরী উদ্ধার হয়েছে। হাড়োয়ার কিশোরীকে পুলিশ উদ্ধার করে মোবাইল ফোনের সূত্রে।
পুলিশ জানিয়েছে, ২৪ জুন বসিরহাটের হাড়োয়ায় স্কুলে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী। পরিবার হাড়োয়া থানায় অভিযোগ জানায়। এর কিছুদিন পরেই বাড়িতে মেয়েটির একটি ফোন আসে। মেয়েটি বলে, “আমাকে বাঁচাও। আমাকে দিল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।” মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ দিল্লির যৌনপল্লিতে। মোবাইল জমা রেখে ঢুকতে হয় কোঠায়। কিন্তু হাড়োয়ার কিশোরীর অনুরোধে দিল্লিবাসী এক বাঙালি যুবক জুতোর সোলের মধ্যে করে ভিতরে নিয়ে যায় মোবাইল।
সেই ফোনের সূত্র ধরেই তদন্তে নামে পুলিশ। পাচারকারীদের খোঁজে উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশের একটি বিশেষ দল দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু করে। কমলা মার্কেট থানার জি বি রোডের ৫৬ নম্বর কোঠা থেকে উদ্ধার হয় মেয়েটি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজারের বাসিন্দা কোঠা মালিক মুসলিমাও ধরা পড়ে।
কী ভাবে ফাঁদে পড়ল মেয়েটি?
সোমবার মেয়েটি জানায়, একদিন বাসে তানজিরা ভাব জমায় তার সঙ্গে। তারপর ফোন করে ভাব জমায়। নিজের ভাই পরিচয় দিয়ে একদিন সে আলাপ করিয়ে দেয় সাব্বিরের সঙ্গে। ফোনে আলাপ জমিয়ে, পরে দেখা করে সাব্বির বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ২৪ জুন স্কুলের জন্য বেরিয়ে সাব্বির ও তানজিরার সঙ্গে পালিয়ে যায় সে।
পুলিশের জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছে, মেয়েটির পরনে স্কুলের পোশাক ছিল। তাই প্রথমে গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে সালোয়ার কামিজ কিনে বালিগঞ্জ স্টেশনের শৌচালয়ে গিয়ে মেয়েটির পোশাক পাল্টায়। সেখান থেকে তানজিরা চলে যায়। ঘুঁটিয়ারি শরিফের একটি লজে একরাত কাটানোর পর চলে যায় সাব্বিরও। তাদের পরিচিত আর এক মহিলার সঙ্গে দিল্লি আসে মেয়েটি। সে-ই তাকে মুসলিমার কোঠায় তোলে। ওই মহিলারও খোঁজ করছে পুলিশ।
স্কুলছাত্রী কিশোরী পুলিশকে জানিয়েছে, কখনও ৭০ নম্বর বাঙালি কোঠা কখনও ৫৬ নম্বর কোঠা কখনও পানিপথের একটি কোঠায় তার উপরে অত্যাচার চালানো হয়। এর মধ্যেই দিল্লির বাসিন্দা এক বাঙালি যুবকের সহায়তায় সে বাড়িতে ফোন করে। সেই ফোনের সূত্র ধরে বসিরহাটের মালতিপুরে তানজিরার বাড়ি হানা দেয় পুলিশ। তানজিরার বাড়ি থেকে হাড়োয়ার বাসিন্দা স্কুল-পোশাক পড়া ১৭ বছরের আরেকটি মেয়েকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাকেও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সাব্বির।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “তানজিরার বাড়ি থেকে উদ্ধারের পর মেয়েটিকে যখন বাড়ি পৌঁছে দিই তখনও তার পরিবার নিখোঁজ ডায়রি করেনি। স্কুলে না গিয়ে মেয়ে যে অন্য কোথাও গিয়েছে, সেই চরম বিপদের আঁচও পাননি তাঁরা।”