Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ভোল পাল্টে ভেল্কি, বিভ্রান্ত বিজ্ঞানীরাও

এক দিকে, কয়েক হাজার বিজ্ঞানী, উন্নত গবেষণাগার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ। অন্য দিকে, ওরা। মানে, তিন প্রজাতির মশা।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৩
Share: Save:

এক দিকে, কয়েক হাজার বিজ্ঞানী, উন্নত গবেষণাগার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ। অন্য দিকে, ওরা। মানে, তিন প্রজাতির মশা।

তবুও লড়াইয়ে পাল্লা ভারী মশারই। হাজার চেষ্টা করেও বিনাশ করা যায়নি অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই, এডিস ইজিপ্টাই এবং কিউলেক্স বিশনোই মশার। বরং বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীরা যে রক্ষাকবচ তৈরি করেছেন, তা ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে তারা।

আর তার জেরেই এখনও নিয়ম করে বর্ষার সময় এবং ঠিক তার পরে হানা দিচ্ছে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি এবং এনসেফেলাইটিস। যে হেতু পশ্চিমবঙ্গে ওই তিন মশারই বংশবিস্তারের অনুকূল পরিস্থিতি রয়েছে, তাই ফি বছর ওই তিন ধরনের মশাবাহিত রোগে মৃত্যু হচ্ছে বেশ কিছু মানুষের। কোনও বার আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গি, কখনও ম্যালেরিয়া, কখনও এনসেফেলাইটিস।

পতঙ্গবিদেরা বলছেন, এক সময় ম্যালেরিয়া নিবারণ কর্মসূচিতে অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাইয়ের বংশ লোপ করতে প্রয়োগ করা হতো ডিডিটি। তাতে ছয়-সাতের দশকে নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল ম্যালেরিয়া। ওই কীটনাশকে মারা যাচ্ছিল অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই মশার লার্ভা এবং পূর্ণাঙ্গ মশা। কিন্তু দেখা গেল, মশারা শেষ পর্যন্ত হার মানেনি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের থেকে অবসর নেওয়া এক পতঙ্গবিদের ব্যাখ্যা, ‘‘আটের দশকে দেখা গেল, ডিডিটি ছড়ালেও আর মশা মারছে না। জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে তারা ডিডিটি প্রতিরোধী হয়ে গিয়েছে।’’

ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে এর পরে এল নতুন কীটনাশক ম্যালাথিয়ন। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অবসরপ্রাপ্ত এক পতঙ্গবিদ জানাচ্ছেন, ‘‘নয়ের দশকে মশা মারার কাজে ম্যালাথিয়ন খুবই সফল। কিন্তু বহু ব্যবহারে এক সময় এই কীটনাশককেও হজম করে নিল মশারা। ফের বিভ্রান্ত বিজ্ঞানীরা।’’ এখন পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা মারার জন্য কলকাতা পুরসভা বাড়ির ভিতরে পাইরিথ্রিন স্প্রে করে। আর বাড়ির বাইরে মশার লার্ভা মারার জন্য ব্যবহার করে বিটিআই, টেমিফস জাতীয় কীটনাশক। আপাতত ওই সব কীটনাশকে মশা ও লার্ভা মারা যাচ্ছে বলে দাবি পুরসভার পতঙ্গবিদদের। তাঁদের আরও দাবি, সারা দেশে এখন কলকাতা পুরসভার এই মডেলই সব থেকে কার্যকর।

কলকাতা পুরসভার পতঙ্গবিদ দেবাশিস বিশ্বাস মশার চরিত্র নিয়ে বহু দিন গবেষণা করছেন। দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘আমরা এক ভাবে মানুষকে সতর্ক করছি, আর মশারা নিজের মতো করে স্বভাব বদলে আমাদের কর্মসূচিকে ধোঁকা দিচ্ছে।’’ পুরসভার ওই পতঙ্গবিদ বলেন, ‘‘আমরা জানতাম, অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই রক্ত খেয়ে ঘরের দেওয়ালে বসে বিশ্রাম নেয়। তখন সহজেই তাদের মারা যায়। কিন্তু এখন আর তারা ওই ভাবে বিশ্রাম নেয় না। লুকিয়ে পড়ে ঘরের আনাচে-কানাচে।’’ কেবল তা-ই নয়, দেবাশিসবাবুরা গবেষণায় দেখেছেন, অ্যানোফিলিসের আঁতুড়ঘরও বদলেছে। ওই পতঙ্গবিদ বলেন, ‘‘আগে জানতাম, অ্যানোফিলিস মাটিতে কিংবা ঘরের বাইরে রাখা পাত্রের জলে ডিম পাড়ে। কিন্তু এখন দেখছি, এডিস মশার মতো বাড়ির ছাদে জমা জলেও ডিম পাড়ছে ওরা।’’

এডিস মশার স্বভাবও যে ভাবে বদলাচ্ছে, তাতেও বিভ্রান্ত পতঙ্গবিদেরা। কী ভাবে? দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘বইতে পড়েছি, এডিস ইজিপ্টাই মশা ঘরের ভিতরে রাখা পাত্রে পরিষ্কার জলে ডিম পাড়ে। কারণ, ঘরের ভিতরের তাপমাত্রা ওদের ডিম পাড়ার পক্ষে আদর্শ। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, বাড়ির বাইরে রাখা পরিষ্কার জলভর্তি পাত্রেও ডিম পেড়ে যাচ্ছে এডিস মশা। আমরা প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, এখন হামেশাই পাচ্ছি। এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলতে হচ্ছে, ডেঙ্গির মশা শুধু ঘরে নয়, বাইরেও জন্মায়।’’

তবে এনসেফ্যালাইটিসের বাহক কিউলেক্স বিশনোই মশার স্বভাবে কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না, এখনও জানতে পারেননি পতঙ্গবিদেরা। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের এক অবসরপ্রাপ্ত পতঙ্গবিদ জানান, সাধারণত এই প্রজাতির মশা জন্মায় ধানখেতে। ধান রোয়ার পরে মাঠে জল থাকে। কিউলেক্স বিশনোই মশার সেটাই হল ডিম পাড়ার আদর্শ স্থান। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া শহরকেন্দ্রিক রোগ হলেও এনসেফেলাইটিস তাই মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। ‘‘তবে ২০১৪ সালে উত্তরবঙ্গের শহরাঞ্চলে যে ভাবে রোগটা ছড়িয়েছিল, তাতে মনে হয় কিউলেক্স বিশনোই মশাও নিজেদের ডিম পাড়ার জায়গা বদলেছে। হয়তো শহরাঞ্চলেও তারা ডিম পাড়ার জায়গা খুঁজে পেয়েছে,’’ মন্তব্য ওই পতঙ্গবিদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dengue Scientist Virus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE