কেন্দ্রের ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পরপর দু’দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সুতির সাজুর মোড় এবং শমসেরগঞ্জে। তারও পরের দিন, ১২ এপ্রিল উত্তপ্ত এলাকায় বিজেপিকে মিছিল করতে দেওয়া হয়েছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের দাবি। সেই সকালে জাফরাবাদে বাবা-ছেলে খুন হলেন, বেতবোনায় বাড়ি বাড়ি লুটপাট, তাণ্ডব হল আর অন্য দিকে ধুলিয়ানের কয়েকটি পাড়ায় গুলি। তার পরে?
গুলি লাগার পরে কেউ স্থানীয় হাসপাতালে, কেউ এলাকার চিকিৎসক ধরে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়েছেন। দূরে নিয়ে যাওয়ার গাড়ি সে দিন মেলেনি। পরে কেউ পাকুড় (ঝাড়খণ্ড কাছেই), বহরমপুর বা কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। আখতারুলকে যেমন বাড়ি এনেও আবার নিয়ে যেতে হয়েছে বহরমপুরের হাসপাতালে। সেখানেই ১২ বছরের এক কিশোরের কিডনি নষ্ট হয়েছে গুলির আঘাতের জেরে।
জাফরাবাদ, বেতবোনায় দফায় দফায় নামী-দামি লোকেদের পা পড়েছে। রাজ্যপালও ঘুরে গিয়েছেন। অথচ ঘটনার পরে এত দিন কেটে গেলেও প্রশাসনের তরফে কেউ এসে গুলিবিদ্ধদের পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। আহতদের তরফে কেউ থানায় গিয়ে এফআইআর-ও করেননি। এমনকি, শমসেরগঞ্জে এসে মুখ্যমন্ত্রী বিডিও দফতরে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আর্থিক সাহায্য দিলেও গুলিবিদ্ধদের বাড়ির কেউ সেখানে ডাক পাননি! তাঁরা জানাচ্ছেন, স্থানীয় পুর-প্রতিনিধিরা (সকলেই তৃণমূল কংগ্রেসের) এসে কিছু টাকা দিয়ে গেলেও তদন্তের বিষয়ে কিছু বলেননি। ধুলিয়ানের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুর-প্রতিনিধি মহম্মদ পারভেজ (পুতুল) আলমেরও অভিযোগ, ‘‘পুলিশ একটু সক্রিয় থাকলে এমন অশান্তি তো হতই না। এই পরিবারগুলোর অভিযোগও কেউ নেয়নি।’’
ঘটনার পরে আইজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম বলেছিলেন, পুলিশ চার রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। ধুলিয়ানের এত গুলি যে পুলিশের নয়, স্থানীয় বাসিন্দারাই বলছেন। উল্টে ঘটনার পরে নিরীহ বেশ কিছু লোকজনকে ধর-পাকড় করা হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। এক পুলিশ-কর্তার বক্তব্য, ‘‘গোটা ঘটনায় বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) হয়েছে। তারা সব বিষয়ই দেখবে।’’ এমতাবস্থায় পুলিশ সুপার এবং জেলাশাসককে আহতদের তালিকা দিয়ে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর দাবি, পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত করুক এবং সরকার আহতদের চিকিৎসার ভার নিক।
গুলি যাঁদের লেগেছে, তাঁরা সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন, এই তকমা দিয়ে বিজেপি নেতারা এঁদের ধারপাশ মাড়াননি। পুলিশের গুলিতে নিহত সুতির কাশিমনগরের যুবকের (যিনি মামারবাড়ি যাওয়ার পথে সাজুর মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন বলে পরিবারের দাবি) বাড়িতেও তাঁরা যাননি একই কারণে। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী হাসপাতালে এবং এলাকায় ঘুরে এঁদের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন, পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। আহতদের দেখতে গিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারও। অধীর বলছেন, ‘‘এঁরা কেউ মায়ের ওষুধ আনতে গিয়ে, কেউ দোকানে যেতে গিয়ে গুলি খেয়েছেন। আমাদের দাবি, মুখ্যসচিব বা সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হোক, প্রশাসন বিএসএফ-কে ডাকেনি। আর যদি সত্যিই বিএসএফ নিজে থেকে এই কাণ্ড করে থাকে, তা হলে সরকার আইনি পদক্ষেপ করুক। মুখ্যমন্ত্রী শুধু রাজনীতির খেলা খেলে চলে গেলেন! এঁদের দেখতে গেলেন না কেন?’’
এত জন গুলিবিদ্ধ অথচ কংগ্রেস ছাড়া কেউ সরব নয় কেন? বিএসএফের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী গুরুতর অভিযোগ তুললেও ফরেন্সিক, ব্যালিস্টিক পরীক্ষা-সহ কোনও তদন্তের কথা তৃণমূলই বা বলছে না কেন? শাসক দলের বহরমপুর-মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অপূর্ব সরকারের বক্তব্য, ‘‘ধীরে ধীরে হবে, সবই ধরা পড়বে। বেলডাঙায় কার্তিক পুজো ঘিরে গোলমালটা যে শুরু করিয়েছিল লাইটের বোর্ড পাল্টে দিয়ে, তাকেও তো দেড়-দু’মাস পরে ধরে আনা হয়েছিল।’’
ইনসান, আখতারুল, সমসেররা জানেন না, বিচারের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ কবে আসবে!
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)