E-Paper

নগদের বাইরে কী চাহিদা-বঞ্চনা, ভাবেন না নেতারা

মেয়েদের নিজস্ব টাকা না নেহাতই ভোটের দান? লক্ষ্মীর ভান্ডার ঘিরে কিছু প্রশ্ন।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৩২

—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

মেয়ে চাষিদের কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গে খুব বেশি নেই। ‘কোচবিহার জেলা প্রমীলা বাহিনী ফার্মার্স প্রডিউসার্স কোম্পানি’ সে দিক থেকে বিশিষ্ট। কোম্পানির চেয়ারপার্সন সাজিদা পারভিন জানালেন, লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে কে কী ভাবছে, এক দিন আলোচনায় সে কথাটা উঠে এসেছিল। অধিকাংশ মেয়েই বলেছিলেন, টাকাটা তাঁদের চাই। “এই যে শীতের সময় একটা গরম ব্লাউজ, কি একটা চাদর কিনতে পারছি, কারও বাধা দেওয়ার জো নেই, সে তো ওই টাকার জন্যেই।” নিজের টাকা নিজের অধিকারের বোধ তৈরি করে। কিন্তু সেই অধিকারের পিছনে লুকিয়ে আছে অনেকখানি অধিকারহীনতা, আক্ষেপ সাজিদার। “আমরা ৪৫৮ জন মহিলা সদস্যকে ধান, ভুট্টা, আনাজের বীজ দিই, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। এ বছর থেকে আমরা এমএসপি দিয়ে ধানও কিনছি। কিন্তু সেই টাকা ঢুকছে সদস্যদের স্বামীর অ্যাকাউন্টে। কারণ জমির কাগজে স্বামীর নাম।” সারা বছর জমিতে চাষের কাজ করেও মেয়েদের ভরসা লক্ষ্মীর ভান্ডারের ক’টা টাকা।

চাষি মেয়ের এই বঞ্চনাকে কি কোনও ভাবেই ভোটের মঞ্চে তোলা যায় না? “সব দলের কাছে দাবি করছি, মেয়েদের নামে জমির রেজিস্ট্রেশন করলে যেন ফি মকুব করা হয়। তাতে অনেক পরিবার মেয়েদের নামে জমি কিনবে।” বলেন সাজিদা। ‘শ্রম যার জমি তার’— এই দাবি তোলা রাজনীতিরই কাজ। মেয়েদের এমন মৌলিক দাবিকে এড়িয়ে যায় অনুদান প্রকল্প।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে। ফল পেয়েছিলেন হাতে-হাতে— বিজেপির প্রতি তফসিলি জাতি-জনজাতির সমর্থনে ভাঙন ধরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে ৮৪টি বিধানসভা নির্বাচনী আসন সংরক্ষিত তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে এগুলির ৪৬টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেল সেগুলির মধ্যে ৩৮টি আসন। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে (২০২৪) তা দাঁড়াল ৩৩টি আসনে। অবশ্যই লক্ষ্মীর ভান্ডার তার একমাত্র কারণ নয়— ২০২১ সালে সিএএ-কে সব তফসিলি জাতি, জনজাতি সমর্থন করেনি।

কিন্তু টাকা দিয়েও দলিত মেয়েদের একটা অংশের ভোট তৃণমূল টানতে পারেনি, তা-ও তো দেখা গিয়েছে। এঁরা অধিকাংশই শ্রমজীবী মেয়ে। নগদের বাইরে কী তাঁদের চাহিদা, তা কি নেতারা ভেবেছেন? ভেবেছেন কি, কেমন করে সামাল দেবেন বেড়ে-চলা প্রত্যাশাকে? এখনই হাওয়ায় ঘুরছে প্রশ্ন, নীতীশ দশ হাজার টাকা দিলেন, মমতা কত দেবেন? মমতা জনসভায় বলছেন, তাঁর সরকার তো বছরে বারো হাজার টাকা দিয়েই আসছে। এতেই হবে? নানা জেলার মেয়েরা বললেন, এটা কারও ‘ঘরের টাকা’ নয়, রাজ্যের মানুষেরই টাকা।

তবে টাকা ছড়ালেই ভোট মেলে, এমন তো নয়। অন্ধ্রপ্রদেশে জগন রেড্ডি ‘নবরত্ন’ (ন’টি প্রকল্পের মধ্যে দরিদ্র মেয়েদের বছরে ১৫ হাজার টাকাও ছিল) পাঁচ বছর চালানো সত্ত্বেও ২০২৪ বিধানসভা ভোটে হেরেছেন। তেলঙ্গানায় ২০১৮ সালে বিধানসভা ভোটের আগে ‘রায়তবন্ধু’ চালু করে বিপুল ভোটে জিতেছিলেন কেসিআর। তবু ২০২৩ সালে হারলেন। গত লোকসভা ভোট-পরবর্তী সমীক্ষা দেখিয়েছে, রেশন, পিএম আবাস, উজ্জ্বলা থেকে উপকৃতদের প্রায় ৬০ শতাংশ কেন্দ্রকে প্রকল্পের কৃতিত্ব দিয়েছেন, কিন্তু মাত্র ৪৫ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। “জনকল্যাণ প্রকল্পগুলি চালু করার পর কত বার ভোটে সুফল আশা করতে পারে শাসক দল, সে প্রশ্ন উঠছে,” বলেন অধ্যাপক অশোক সরকার।

বাড়তি টাকা বাড়তি ভোট আনতে হয়তো পারে, কিন্তু পাশাপাশি আরও গাঢ় হয়ে দেখা দিতে পারে বঞ্চনার ছবি— স্কুল, অঙ্গনওয়াড়িতে শিশুর পাতে ডিমের আকাল, সরকারি শিক্ষার ভগ্নদশা, প্রশাসনে অজস্র শূন্যপদ। জেলাশাসকের দফতর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র মাসে ছ’সাত হাজার টাকার চুক্তিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা। হতাশা ছাপ ফেলছে রাজ্য সরকারের কলেজে ভর্তির পোর্টালে — এ বছর মোট আসনের মাত্র ২৮.৮২ শতাংশ আসনে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে যা নজিরহীন, জানালেন এসইউসিআই নেতা তরুণ নস্কর। সন্তানদের শিক্ষার জন্য শ্রমজীবী মায়েরা প্রাণপাত করেন। সেই বিনিয়োগ ব্যর্থ হওয়ার ক্ষতি কি অনুদানের টাকায় পূরণ হয়?

এ সবই হতে পারত নির্বাচনের বিষয়। কিন্তু তা করবেন কারা? শহরগুলোতে যদি বা বিরোধী দলগুলির কিছু মহিলা কর্মী থাকেন, গ্রামে তাঁদের সক্রিয়তা দেখাই যাচ্ছে না, বলেন মেয়েরাই। অথচ, বিহারে যেমন ‘জীবিকা দিদি’-রা নেমে পড়েছিলেন নীতীশ সরকারের হয়ে প্রচারে, তেমন পশ্চিমবঙ্গে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রীরাও তৃণমূলের শক্ত খুঁটি। গ্রামের মেয়েদের উপর তাঁদেরপ্রভাব যথেষ্ট।

তবে নির্বাচনই তো সেই সময়, যখন মেয়েদের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় শাসক। বাধ্য হয় তাদের কথা শুনতে। সেখান থেকেই হতে পারত সংশোধনের শুরু।

হবে কি?

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lakshmir Bhandar Lakshmi Bhandar Scheme Lakshmi Bhandar Project West Bengal government TMC Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy