‘জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদীদের কোনও ধর্ম নেই। তারা মানবতার শত্রু। এই পরিস্থিতিতে আরও বেশি মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াও।’
পহেলগামে জঙ্গি হানার ঘটনার পরে কলকাতার অনেক স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকারা তাঁদের পড়ুয়াদের এই পাঠই দিচ্ছেন। শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, স্কুলের প্রার্থনা বা ক্লাস চলাকালীন যখনই সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা, পড়ুয়াদের বোঝাচ্ছেন যে, এমন আবহে ঘৃণা নয়। বরং, সব ধর্মের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, বহু সাধারণ মানুষ এখন অসহায়।
যেমন মিত্র ইনস্টিটিউশন, ভবানীপুরের প্রধান শিক্ষক রাজা দে জানাচ্ছেন, পহেলগামে জঙ্গি হানার ঘটনার পরেই পড়ুয়াদের ওই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছেন তিনি। তখনই বিষয়টি নিয়ে ওদের সঙ্গে আলোচনার কথা তাঁর মনে হয়েছিল। কারণ, এখন স্কুলের পড়ুয়াদের অনেকেই সমাজমাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত। সেখানে যে ভাবে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তিত অনেক শিক্ষকই। পড়ুয়াদের মধ্যে যাতে সেই ঘৃণার কোনও স্থায়ী প্রভাব না পড়ে, তাই ওদের সঙ্গে ঘটনাটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করছেন রাজা।
তিনি বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের বলেছি, যারা ঘটনাটা ঘটিয়েছে, তারা সন্ত্রাসবাদী। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ওদের পাশে নেই। কাশ্মীরের মানুষ এ সবের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করছেন। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের পরিচয় ভারতীয়। কাশ্মীরের বেশির ভাগ মানুষ পর্যটনের উপরে নির্ভর করে সংসার চালান। এখন এমন পরিস্থিতিতে অনেকে হয়তো কাজও হারাবেন বা হারিয়েছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ঘৃণা ছড়ালে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে।’’
অষ্টম শ্রেণিতে বাংলার পাঠ্যক্রমে রয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ‘দাঁড়াও’। সেই কবিতাই এখন ক্লাসে ক্লাসে ব্যাখ্যা করে বলছেন বেলগাছিয়া মনোহর অ্যাকাডেমির শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ওই স্কুলের শিক্ষিকা সুমনা সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘দাঁড়াও’ কবিতার কয়েকটি লাইন হল— মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও/মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও/মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।’’ সুমনা জানান, এই কবিতা ব্যখ্যা করে বোঝানো হচ্ছে, এখন ঘৃণা নয়, বেশি করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় এটা। ওই স্কুলের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, তাঁদের স্কুলে হিন্দু ও মুসলিম পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় সমান। পড়ুয়াদের মধ্যে যেন কোনও ধরনের ঘৃণার আবহ না ছড়ায়, তা তাঁরা দেখছেন। সমাজমাধ্যমের অ্যাকাউন্টে তারা কী পোস্ট করবে, আর কী করবে না— সেই নিয়েও পরামর্শ দিয়েছেন।
রামমোহন মিশন হাই স্কুলের অধ্যক্ষ সুজয় বিশ্বাস জানান, তাঁদের স্কুলে প্রতি বছর রামমোহন রায়ের জন্মদিন পালন হয় ২২ মে। বছর বছর রামমোহনের লেখা কোনও গান দিয়ে উদ্বোধন হয় অনুষ্ঠানের। সুজয় বলেন, ‘‘এ বার পহেলগামের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে সঙ্গীতের বদলে হবে আবৃত্তি। সেখানে পাঠ হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারততীর্থ’ কবিতা। যে কবিতার প্রথম দু’টি লাইন— হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’’ সুজয় জানান, এই কবিতায় কয়েকটি লাইন আছে, ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন— শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ পড়ুয়াদের এ সবের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
যাদবপুর বিদ্যাপীঠে প্রার্থনা সঙ্গীতের পরে বাণী পাঠ হয়। এখন সেই বাণী পাঠে সর্বধর্মের পাঠ হচ্ছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য বলেন, ‘‘আসলে স্কুলে বাণী পাঠের মাধ্যমে পড়ুয়াদের চরিত্র গঠন এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পাঠ দেওয়া হয়।’’ পড়ুয়া ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কথা বললে তাকে বোঝানো হয়, কেন এটা বলা উচিত নয়। প্রয়োজনে কাউন্সেলিংও করা হয়।
পড়ুয়াদের ভারতের সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন দমদম সুভাষনগর হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক সাইদুল ইসলাম। পড়ুয়াদের বলছেন, ‘‘অজানতে এমন কোনও মন্তব্য করবে না, যাতে কেউ আঘাত পায়।’’ তাঁর মতে, এই সচেতনতা থাকতে হবে শিক্ষকদের মধ্যেও।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)