Advertisement
E-Paper

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ভিডিওই হাতিয়ার, চেনা কায়দায় ‘মুক্তাঞ্চল’ ভাঙড়

এক দশক আগে রাস্তা কেটে, গাছের গুঁড়ি ফেলে, পুলিশ খেদিয়ে ‘মুক্তাঞ্চল’ গড়েছিল নন্দীগ্রাম। টানা অবরোধ চালিয়ে আন্দোলনের আর এক চেহারা দেখিয়েছিল সিঙ্গুর। কলকাতার উপকণ্ঠে ভাঙড়ও গত দু’দিন ধরে কার্যত ‘মুক্তাঞ্চল’। এবং ঠিক সেই চেনা কায়দায়।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৩
গ্রামবাসীদের সঙ্গে বৈঠকে শর্মিষ্ঠা ও অলীক চৌধুরী। — নিজস্ব চিত্র

গ্রামবাসীদের সঙ্গে বৈঠকে শর্মিষ্ঠা ও অলীক চৌধুরী। — নিজস্ব চিত্র

এক দশক আগে রাস্তা কেটে, গাছের গুঁড়ি ফেলে, পুলিশ খেদিয়ে ‘মুক্তাঞ্চল’ গড়েছিল নন্দীগ্রাম।

টানা অবরোধ চালিয়ে আন্দোলনের আর এক চেহারা দেখিয়েছিল সিঙ্গুর।

কলকাতার উপকণ্ঠে ভাঙড়ও গত দু’দিন ধরে কার্যত ‘মুক্তাঞ্চল’। এবং ঠিক সেই চেনা কায়দায়।

ভাঙড়ে জমি আন্দোলন হয়নি ঠিকই, কিন্তু সেখানেও একই ভাবে ঢুকতে পারছেন না পুলিশ এবং শাসক দলের কোনও নেতা। পাওয়ার গ্রিডের নির্মীয়মাণ সাব-স্টেশন সংলগ্ন খামারআইট, গাজিপুর উড়িয়াপাড়া, টোনা, শ্যামপুকুরের মতো গ্রামগুলিতে ধিকি ধিকি জ্বলছে শাসক-বিরোধী অসন্তোষের আগুন।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন ছিল বাম আমলে। কিন্তু ভাঙড়-পর্ব ঘোর তৃণমূল জমানায়। কী ভাবে তবে এক হয়ে গেল তিন আন্দোলনের কৌশল?

তখন গোয়েন্দারা যা বলেছিলেন, এ ক্ষেত্রেও তা-ই বলছেন। ভাঙড় আন্দোলনের নেপথ্যে তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব, প্রোমোটারদের স্বার্থ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ‘হাইজ্যাক’ করে নেয় নকশালদের সক্রিয়তা। গ্রামবাসীদের তারা শিখিয়েছে, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে কী ভাবে আন্দোলন হয়েছিল। গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখিয়েছে, দুই আন্দোলনের ছবি, ভিডিও। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এলাকার কিছু দুষ্কৃতীর মাধ্যমে জোগাড় করেছে অস্ত্রশস্ত্রও। আটঘাট বেঁধেই মঙ্গলবার তারা নেমেছিল ‘মুক্তাঞ্চল’ তৈরিতে। একাধিক গ্রামবাসীও জানান, ওই দুই আন্দোলনের ছবি দেখিয়ে তাঁদের বোঝানো হয়েছিল জমি বাঁচাতে হলে পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে যেতে হবে। রাস্তা আটকাতে হবে।

গোয়েন্দাদের ধারণা, এ রাজ্যে নকশাল আন্দোলন পথ হারিয়েছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে নকশালপন্থী নেতারা হাত গুটিয়ে বসেই ছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজারহাটে একটি ছোট জমি আন্দোলন হলেও তেমন সাড়া পড়েনি। ভাঙড় ও রাজারহাট প্রায় লাগোয়া এলাকা। ভাঙড়ে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভকে কাজে লাগানো তাই সহজ হয়েছে। ভাঙড়ের আন্দোলনকারীদের নিয়ে এর পর রাজারহাটে নতুন করে আন্দোলনের পরিকল্পনা ছিল নকশাল নেতাদের। তাই ভাঙড়ের জমিরক্ষা কমিটির দখল নিতে সিপিআই (এমএল) রেড স্টারের নেতা অলীক এবং তাঁর স্ত্রী শর্মিষ্ঠা গ্রামগুলিতে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। ২০১২ সালে তিলজলার নোনাডাঙায় জবরদখলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন ওই দম্পতি। বিদ্যুতের সাব-স্টেশন হলে গ্রামবাসীদের নানা শারীরিক সমস্যা হবে বলে আরাবুলরা যে প্রচার চালাচ্ছিলেন, সেই প্রচার আরও দৃঢ় ভাবে গ্রামবাসীদের মনে গেঁথে দিয়েছেন তাঁরা। একাধিক গ্রামের বাসিন্দা জানিয়েছেন, শর্মিষ্ঠা তাঁদের বাড়িতে কয়েক দিন করে থেকে আলোচনা চালাতেন। স্বামী অলীক পরে এসে সভা করতেন।

তবে গোয়েন্দাদের নিশানায় শুধু ওই দম্পতি নয়, রয়েছে আরও কিছু নকশাল সংগঠন, তাদের পাঁচটি ছাত্র সংগঠন, যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশালপন্থী দু’টি ছাত্র সংগঠন ও একটি মানবাধিকার সংগঠন। তারাও পাওয়ার গ্রিড বিরোধী প্রচার চালিয়ে গিয়েছে নাগাড়ে। প্রচারের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে ‘পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বাঁচাও কমিটি’ গড়ে তারা। একই সঙ্গে চিকিৎসক-অধ্যাপকদের এনে প্রচার হয়। গোয়েন্দাদের দাবি, এই সংগঠনগুলিই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। দাগি অপরাধীদেরও তারা জমিরক্ষা কমিটিতে সামিল করেছিল। যাতে অস্ত্রের অভাব না হয়। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, ‘‘ডাকটাই ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের। ওই সংগঠনগুলির সঙ্গে জাতীয় স্তরের একাধিক মাওবাদী নেতা যোগাযোগ রাখছিলেন।’’

মঙ্গলবার ভাঙড়ে কার্যত ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ই হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা রড, লাঠি নিয়ে পুলিশের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পুলিশের এবং পাওয়ার গ্রিডের নিরাপত্তারক্ষীদের অস্ত্র লুঠ হয়েছে। গ্রিডের নির্মীয়মাণ সাব-স্টেশন সংলগ্ন পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘মুক্তাঞ্চল’।

কিন্তু এর প্রস্তুতি-পর্বের খবর কেন পাননি গোয়েন্দারা?

পুলিশ কর্তাদের একাংশ এখন মানছেন, কয়েক মাস ধরে নকশালরা তলে তলে যে জমি তৈরি করছিল, তা টের না পাওয়াটা তাঁদের ব্যর্থতা। এখন তেড়েফুঁড়ে উঠে ওই দম্পতির নামে এফআইআর করেছে পুলিশ। কিন্তু পুলিশের দাবি, কাজ সেরে তাঁরা ‘পলাতক’। তাঁদের হয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন গ্রামের কিছু মানুষই। এ দিন সে কথা জানিয়েছেন নকশাল নেত্রী শর্মিষ্ঠা নিজেও। তিনি ফোনে আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘বহিরাগত বলে সরকার আমাদের আন্দোলনে বাধা দিচ্ছে। এটা অসাংবিধানিক। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, গ্রামবাসীদের গায়ে পুলিশ যেন হাত না দেয়। কিন্তু ছ’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আন্দোলন চলছে, চলবে।’’

ভাঙড় আন্দোলনের সমর্থনে মিটিং-মিছিল চলছেও কলকাতায় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। আক্রমণের লক্ষ্য এক সময়কার নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের নেত্রী মমতাই। এ দিন নকশাল সংগঠন সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সজল অধিকারী বলেন, ‘‘কৃষিজমি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মমতা ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু ভাঙড়ে কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে হবে।’’

Bhangar Murder Investigation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy