E-Paper

পায়ে ধরেও রেহাই পাইনি: সোনালি বিবি

মালদহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়ে বেলা ২টো নাগাদ সোনালির অ্যাম্বুল্যান্স বীরভূমের পাইকরের দর্জিপাড়ায় পৌঁছতেই উচ্ছ্বাস বাঁধ ভাঙে সোনালির বাড়ির লোকেদের।

দয়াল সেনগুপ্ত  , অভিজিৎ সাহা

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:১৯
ছ’মাস পরে মাকে পেয়ে আদর মেয়ের। শনিবার বীরভূমের পাইকরে, সোনালি বিবিকে দেখতে পেয়ে অ্যাম্বুল্যান্সেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়ে।

ছ’মাস পরে মাকে পেয়ে আদর মেয়ের। শনিবার বীরভূমের পাইকরে, সোনালি বিবিকে দেখতে পেয়ে অ্যাম্বুল্যান্সেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়ে। ছবি: রিন্টু পাঁজা

কী ভাবে তাঁকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়েছিল, ভাবলেই অস্বস্তি হচ্ছে বীরভূমের পরিযায়ী শ্রমিক সোনালি বিবির। জানান, দিল্লি পুলিশের হাতে-পায়ে ধরেও রক্ষা পাননি। গ্রেফতার করে পাঠানো হয় অসমে। জোর করে বাংলাদেশ সীমান্তের জঙ্গলে ছেড়ে দেয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। সোনালির স্বামী দানিশ শেখ, পড়শি সুইটি বিবি ও তাঁর দুই নাবালক সন্তান এখনও বাংলাদেশে। স্বামী না ফেরায় চোখের জল ফেলে অন্তঃসত্ত্বাসোনালি শনিবার বলেছেন, “বাংলাদেশের ভাড়াবাড়িতে স্বামী এবং সুইটি বিবি ও তার বাচ্চারা রয়েছে। আমরা আসার সময় সবাই খুব কাঁদছিল। ওদের কান্না এখনও যেন কানে বাজছে!”

মালদহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়ে বেলা ২টো নাগাদ সোনালির অ্যাম্বুল্যান্স বীরভূমের পাইকরের দর্জিপাড়ায় পৌঁছতেই উচ্ছ্বাস বাঁধ ভাঙে সোনালির বাড়ির লোকেদের। অপেক্ষায় ছিল সোনালির বছর পাঁচেকের মেয়ে। বাংলাদেশে প্রায় ছ’মাস (তিন মাস সংশোধনাগারে) থাকার পরে, মাকে এ দিন কাছে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিশুকন্যা। অ্যাম্বুল্যান্সেই সোনালিকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু এঁকে দেয় একরত্তি। সোনালিকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। দেশে ফেরা বছর ছাব্বিশের এই মেয়েকে দেখার জন্য রাস্তার দু’ধারে এলাকাবাসী প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাতে লেখা ‘মোদের মাতৃভাষা বাংলা আমরা বাংলাদেশি নই’, ‘বাঙালি হওয়া কি অপরাধ’, ‘আমার বাংলা আমার ঘর, আমার ভাষা, আমার অহঙ্কার’।

বিকেলে রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সোনালিকে। পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলামের মাধ্যমে সোনালি তাঁর হবু সন্তানের নামকরণের আর্জি জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করায় সামিরুলকেও ধন্যবাদ দেন। সামিরুল বলেন, ‘‘সোনালির ফেরা বাংলা-বিরোধী জমিদারদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের প্রথম ধাপ। দানিশ, সুইটিরাও ভারতীয়। তা-ও নির্বিচারে বাংলাদেশে ঠেলা হয়েছে। ওদের ফেরাতে লড়াই চলবে।’’

সোনালি ও তাঁর নাবালক ছেলেকে শুক্রবার সন্ধ্যায় মালদহের মহদিপুর সীমান্ত দিয়ে দেশে ফেরানো হয়। রাতেই তাঁকে ভর্তি করানো হয় মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার ইউনিটের ভিআইপি কেবিনে বসে ‘পুশ-ব্যাক’-এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এ দিন দৃশ্যত কেঁপে ওঠা সোনালি জানান, যেমন হেনস্থার শিকার হয়েছেন, তার পরে আর দিল্লি যেতে চান না। তাঁর দাবি, দিল্লি পুলিশ তাঁদের বিমানে অসম সীমান্তে নিয়ে যায়। আঁধার নামতেই সীমান্তের জঙ্গলে তাঁদের ছেড়ে দেয় বিএসএফ। প্রাণ বাঁচাতে স্বামী, ছেলে-সহ ছ’জন ঢুকে পড়তে বাধ্য হন বাংলাদেশে। অন্তঃসত্ত্বার আক্ষেপ, “স্রেফ বাংলা বলায় দিল্লি পুলিশ ধরেছিল। পুলিশের হাতে-পায়ে ধরেও রক্ষা মেলেনি। বাংলাদেশেও ভোগান্তির শেষ নেই। বিজিবি-র হাত হয়ে থানা ঘুরে ঠাঁই হয় সংশোধনাগারে। সেখানে ঠিক মতো খাবার জুটত না। বাংলাদেশ থেকে ফিরতে পারব, ভাবিনি!’’

সোনালিকে নিতে পাইকর থেকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজে যান তাঁর বাবা ভদু শেখ। সেখানে তিনি বলেন, “মেয়ে, নাতিকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ বোঝানোর ভাষা নেই। এ বার জামাইকেও ফেরানো হোক।’’ দুপুর ১২টা নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্সে বীরভূমে রওনা দেন সোনালি ও ভদু। অ্যাম্বুল্যান্সের আগে এবং পেছনে বীরভূম ও মালদহ পুলিশের ‘এসকর্ট’। অ্যাম্বুল্যান্সে মালদহ মেডিক্যালের স্ত্রী রোগ বিভাগের চিকিৎসক, নার্স এবং টেকনিশিয়ান ছিলেন। রামপুরহাটে পৌঁছে ভদু বলেন, ‘‘এ দেশের বাসিন্দা হলেও শারীরিক অসুস্থ মেয়েকে জোর করে বাংলাদেশ পাঠানো হয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম, মেয়ের সন্তান এখানে এ দেশেই হোক। জামাইকে নিয়ে চিন্তায় আছি।’’ দানিশ ফিরে এলে, তাঁকে আর দিল্লিতে কাজে যেতে দেবেন না বলেও জানান ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ।

রামপুরহাট স্বাস্থ্য-জেলার সিএমওএইচ শোভন দে জানিয়েছেন, মালদহে পরীক্ষায় ধরা পড়েছিল, সোনালি রক্তাল্পতায় ভুগছেন। রামপুরহাট মেডিক্যালের সুপার ও উপাধ্যক্ষ পলাশ দাস জানিয়েছেন, প্রথমে ভাবা হয়েছিল, সোনালির চিকিৎসায় ‘মেডিক্যাল বোর্ড’ গড়া হবে। তবে তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। রক্তাল্পতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গিয়েছে, আলট্রাসোনোগ্রাফি অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ভূমিষ্ঠ হতে পারে সোনালির সন্তান।

সহ-প্রতিবেদন: অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bangladesh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy